বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতন এবং ভারতীয় মিডিয়ার ব্যাপক অপপ্রচার !
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ব্যানারে ২০২৪ সালের ১ জুলাই সংগঠনটি সৃষ্টি হয় এবং সৃষ্টির পরপরই আন্দোলন সফল করার জন্য ৮ জুলাই সংগঠনটি ৬৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি ঘোষণা করে, যার মধ্যে ২৩ জন সমন্বয়ক ও ৪২ জন সহ-সমন্বয়ক ছিলেন। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পতনের জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম হলেও সে আন্দোলন সমূহ সফলতার মুখ দেখে নাই। ১৯ জুলাই সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা সর্বাত্মক অবরোধ চলে। ওই অবরোধ কর্মসূচিতে ছাত্র জনতাসহ সর্বস্তরের লোক স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে। আওয়ামী লীগের মহাসচিব ওবায়দুল কাদের এর নির্দেশে ছাত্রলীগ,যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ এর কর্মী সমর্থক ছাত্র জনতার শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দেশীয় অস্ত্র ও অবৈধ অস্ত্রের মাধ্যমে আক্রমণ করে। এছাড়া সরকারের নির্দেশে পুলিশ ও বিজিবি ছাত্র জনতার উপর নিবিচারে গুলি বর্ষন করে। মুহূর্তে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ফলে বহু ছাত্র জনতা ও সাংবাদিক মারা যায়, গুলিবিদ্ধ হয় ও আহত হয়। ঢাকা মেডিকেল সহ বিভিন্ন হসপিটাল গুলোতে একটি বীভৎস ও হৃদয় বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এমন অবস্থায় শেখ হাসিনা সরকার হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে রাতের আঁধারে ব্লাক আউট করে আন্দোলনকারীদের খুঁজে খুঁজে বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করতে থাকে। ১৯ জুলাই মধ্যরাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে আটক করা হয় এবং সারাদেশে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। শেখ হাসিনা সরকার ২০ জুলাই থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে সারাদেশে কারফিউ জারি ও সেনা মোতায়েনের করে একই সাথে ৩ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। কিন্তু ২১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি পক্ষ ‘৯ দফা’ দাবি জানিয়ে শাটডাউন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়।
সারাদেশে কারফিউ জারি ও সেনা মোতায়েনের করে একই সাথে ৩ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা ও সকল সরকারি স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষনার পফে আন্দলন কিছুটা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছন্দপতন ঘটে।
২৬ জুলাই নাহিদ ইসলামসহ কোটা সংস্কার আন্দোলনের তিন সমন্বয়ককে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে সাদাপোশাকের এক দল ব্যক্তি। ২৮ জুলাই রাত ১০টার দিকে পুলিশি হেফাজতে থাকা ৬ সমন্বয়ক ডিবি কার্যালয় থেকে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। কিন্তু ডিবি কার্যালয় বসেই বাকি সমন্বয়কারীদের সাথে যোগাযোগ না করে এমন ঘোষণা দেয়ায় এই ঘোষণাকে সরকার ও ডিবি চাপে দেয়া হয়েছে বলে আখ্যায়িত করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় বাকিরা সমন্বয়কগণ।
এদিকে বিভিন্ন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীগণ, বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ ও সাধারন জনগন কারফিউভঙ্গকরে ঢাকাসহ প্রতিটি জেলা উপজেলায় তীব্র প্রতিরোধ গড়ে। ৩১ জুলাই হত্যা, গণগ্রেপ্তার, হামলা, মামলা ও গুমের প্রতিবাদে সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করে। ১ আগস্ট ডিবি হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে বেলা দেড়টার একটু পরেই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ২ আগস্ট শুক্রবার ছাত্র আন্দোলনে শহীদের স্মরণে ‘প্রার্থনা ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল’ কর্মসূচি ঘোষণা করে এবং ডিবি অফিস থেকে প্রচারিত ছয় সমন্বয়ককের ভিডিও বিবৃতিটি তারা স্বেচ্ছায় দেননি বলে জানান।
শেখ হাসিনা সরকার ও তার মন্ত্রিসভা একের পর এক মিথ্যা বক্তব্য দিতে থাকে। আন্দোলনকারীদের দাবি না মেনে সরকার বিভিন্ন দমন পীড়নের মধ্যে আন্দোলন বানচাল করার অপচেষ্টা চালাতে থাতকে এবং মিথ্যা মামলা মিথ্যা চার্জশিট এর মাধ্যমে নিরপরাধ মানুষকে আসামি করতে থাকে। ফলে সমগ্র দেশের মানুষ সরকারের এই স্বৈরাচারী আচরণের প্রতি ক্ষোভে ফেটে পড়ে।
৩ আগস্ট শহীদ মিনার থেকে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম সরকার পদত্যাগের এক দফা আন্দোলন ঘোষণা করেন। এক দফা ঘোষণার সময় শহীদ মিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন অন্যান্য সমন্বয়করা। তারা হলেন নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও আবদুল কাদের।শুরুতে ৬ই আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন "লং মার্চ টু ঢাকা" কর্মসূচি ঘোষণা করে। তবে শেখ হাসিনা সরকার আবার সারাদেশে ২৪ ঘন্টা কারফিউ জারি করে একই সাথে ৩ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে । এই পরিস্থিতি বিবেচনায় সম্বনয়করা কর্মসূচি একদিন এগিয়ে এনে ৫ই আগস্ট "লং মার্চ টু ঢাকা" ঘোষণা করে। আন্দোলনকে ঘিরে ৫ আগস্ট অনেক জেলায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, সংঘর্ষ এবং গোলাগুলির ঘটনা ঘটে, এতেসহশ্রাধিক সাধারন মানুষ ও পুলিশ নিহত হয়।
৫ আগস্ট ১ দফা দাবির প্রেক্ষিতে সম্মিলিত ছাত্র-জনতার এক গণঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করতে এবং দেশত্যাগ করতে বাধ্যহন শেখ হাসিনা। তার ১৫ বছরেরও বেশি সময়ের স্বৈরশাসনের অবসান হয়। ছাত্র জনতার এক অভূতপূর্ব বিজয় সংঘটিত হয়। এ বিজয় কোন দলের না কোন গোষ্ঠীর না কোন সমাজের না এটি বাঙ্গালী জাতীর বিজয়।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় গণঅভ্যুত্থান ও আওয়ামী ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বিদায় সমকালীন বিশ্বে এক নজিরবিহীন ঘটনা। কিন্তু ছাত্র-জনতার এ অভূতপূর্ব গণজাগরণ-গণঅভ্যুত্থান ও আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ষোলো বছরের চরম স্বেচ্ছাচারী আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনের পতন আকস্মিক ঘটনা নয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ ষোলো বছরের ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে দেশের জনগণের বহুমাত্রিক পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ছাত্র-জনতার এ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। চরম দমন-নিপীড়ন মোকাবিলা করে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নৃশংস ফ্যাসিবাদী শাসন বিদায় দিতে জীবনবাজি লড়াই এগিয়ে নিয়েছে। শিক্ষার্থী-জনতা মিলে সেই লড়াই ছত্রিশ দিনে মরণপণ লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে; আওয়ামী ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকার উৎখাত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশের মানুষের বার্তা হবে, আমরা আমাদের এ গণতান্ত্রিক রূপান্তরের অভিযাত্রায় সবার আন্তরিক সমর্থন ও সহযোগিতা চাই। হাসিনা সরকারের হাতে যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, তার নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্তে ইতোমধ্যে জাতিসংঘের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু ভারতীয় মিডিয়া পতিত স্বৈরতন্ত্রী ফ্যাসিবাদের প্রেতাত্মাদের রাজনৈতিক পুনর্বাসনের সহযোগী হিসাবে কাজ করছে। এটি মনে রাখা দরকার, ভারত যদি হাসিনা সরকারকে একরোখা সমর্থন না জোগাত, তাহলে হয়তো আওয়ামী লীগের এ করুণ পরিণতি হতো না। যেহেতু আমরা প্রতিবেশী বদলাতে পারব না, তাই এ দেশের মানুষ ভারতের সঙ্গে সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে সব দ্বিপাক্ষিক সমস্যার দ্রুত সমাধানই কামনা করবে। বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ এ গণঅভ্যুত্থান হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জাতীয় সম্মিলনে সংগঠিত হয়েছে। দেশে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলেও তা নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার যে ব্যাপক অপপ্রচার করছে তা প্রতিবেশী একটি দেশের জন্য শুভকর নয়।
তথ্য বহুল পড়ে ভালো লাগলো।