আমার বাংলা ভাষা মাতৃভূমি

in #bangle8 days ago (edited)

বাংলা ভাষা আমার মাতৃভাষা। এই ভাষার সাথে আমার আত্মার সম্পর্ক, কারণ এটি আমার চিন্তা-ভাবনা, অনুভূতি ও স্বপ্নের ভাষা। বাংলা ভাষা আমাদের সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক, আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী। এই ভাষা শুধু কথা বলার মাধ্যম নয়, বরং এটি আমাদের সত্ত্বার একটি অংশ।

বাংলা ভাষার ইতিহাস দীর্ঘ এবং সমৃদ্ধ। প্রাচীনকালে আর্যদের আগমনের আগে বাংলায় যে ভাষা প্রচলিত ছিল তা অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও চীন-তিব্বতি ভাষাগোষ্ঠীর মিশ্রণে গঠিত। আর্যরা বাংলায় এসে তাদের ভাষার সাথে স্থানীয় ভাষার মিশ্রণ ঘটিয়ে গড়ে তোলে একটি নতুন ভাষা, যা ক্রমশ বাংলা ভাষায় রূপান্তরিত হয়। বাংলা ভাষার প্রথম লিখিত নিদর্শন পাওয়া যায় পাল রাজাদের আমলে, খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে। চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন প্রভৃতি প্রাচীন বাংলা সাহিত্য রচনায় বাংলা ভাষার অপরূপ সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে।

বাংলা ভাষার আধুনিক ইতিহাস শুরু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রমুখের অবদানে বাংলা ভাষা সাহিত্যিক ও পণ্ডিতদের কাছে নতুন মর্যাদা লাভ করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করে। তাঁর লেখায় বাংলা ভাষার সৌন্দর্য ও ব্যঞ্জনা অনন্যরূপে প্রকাশ পেয়েছে।

1000047315.jpg

বাংলা ভাষার জন্য আমরা অনেক সংগ্রাম করেছি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এর একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ না করে উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে, বাঙালি জাতি তার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে। রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ আরও অনেকে প্রাণ দিয়েছিলেন মাতৃভাষার জন্য। এই ভাষা আন্দোলনের ফলে ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

বাংলা ভাষা শুধু বাংলাদেশের ভাষা নয়, এটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম রাজ্যেও বহুল প্রচলিত। এছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বাঙালিদের মাধ্যমেও এই ভাষার প্রচার ও প্রসার ঘটছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী বাংলা ভাষায় কথা বলা লোকসংখ্যা প্রায় ২৫ কোটি, যা বিশ্বে ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা।

বাংলা ভাষার সাহিত্য ভাণ্ডার অত্যন্ত সমৃদ্ধ। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ প্রভৃতিতে বাংলা ভাষার অগণিত রচনা রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বেগম রোকেয়া, জীবনানন্দ দাশ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ লেখকগণের সাহিত্যকীর্তি বাংলা ভাষাকে মহিমান্বিত করেছে।

বাংলা ভাষার সঙ্গীত জগতও অনন্য। রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, লালনগীতি, বাউলগান, ভাটিয়ালি, পল্লীগীতি প্রভৃতি বাংলা সঙ্গীতের ভুবনে বহুল পরিচিত। এই সঙ্গীতগুলো আমাদের মনকে ছুঁয়ে যায়, হৃদয়কে আন্দোলিত করে। বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র জগতেও এই ভাষার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, তপন সিংহ প্রমুখ পরিচালকদের চলচ্চিত্র বাংলা ভাষায় নির্মিত হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক মান অর্জন করেছে।

বাংলা ভাষার গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্য আমাদের গর্বিত করে। আমরা আমাদের ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং এর সংরক্ষণ ও প্রসারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। মাতৃভাষার প্রতি আমাদের ভালোবাসা অবিচল, এবং আমরা সবসময় এর সঠিক ব্যবহার ও সংরক্ষণের চেষ্টা করে যাব।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বাংলা ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবারে, সমাজে, শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি, ভাবি, লিখি। আমাদের সংস্কৃতি, রীতিনীতি, উৎসব-অনুষ্ঠান, খাবার-দাবার, পোশাক-পরিচ্ছদ সবকিছুতেই বাংলা ভাষার প্রভাব স্পষ্ট। আমাদের চিন্তা-চেতনা, আদর্শ, মূল্যবোধ সবকিছুই এই ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এজন্যই বাংলা ভাষা আমাদের জন্য শুধুমাত্র একটি ভাষা নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বের সাথে জড়িয়ে আছে।

বর্তমান যুগে গ্লোবালাইজেশনের ফলে বিভিন্ন ভাষার প্রভাব পড়ছে আমাদের ভাষার উপর। তবে আমরা আমাদের মাতৃভাষার স্বকীয়তা বজায় রেখে এগিয়ে যাচ্ছি। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারেও বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসার ঘটছে। ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন প্রভৃতিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়ছে। বাংলা ভাষার অভিধান, কীবোর্ড, অনুবাদ সফটওয়্যার প্রভৃতির মাধ্যমে আমরা আমাদের ভাষাকে আরও বেশি সহজলভ্য ও সমৃদ্ধ করছি।

আমরা জানি, ভাষা হল জাতির পরিচয়ের অন্যতম প্রধান উপাদান। আমাদের ভাষার প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হল এই ভাষাকে সংরক্ষণ !