বিয়ে পূর্ব যিনা করা দ্বারা বান্দার হক নষ্ট হয় না আল্লাহর হক?
বিয়ে পূর্ব যিনা করা দ্বারা বান্দার হক নষ্ট হয় না আল্লাহর হক?
প্রশ্ন
আস্ সালামু আলাইকুম। হুজুর এর কাছে অনেক গুরুত্ব পূর্ণ প্রশ্ন আছে কোরআন ও হাদিস এর আলোকে উত্তর দিয়ে উপকৃত করবেন..
প্রশ্ন- শরিয়তে জিনা বেপারে কি বলা হয়েছে? আর জিনা করলে কি আল্লাহর হক নষ্ট হয় না কি বান্দার হক নষ্ট হয়? কোন যুবক যুবতী যদি বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পরে তাহলে আল্লাহ কি তাদের ক্ষমা করবেন? আর এখন তাদের কি করা উচিত?শরিয়তের আলোকে একটা সমাধান দিয়ে উপকৃত করবেন।
উত্তর:
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
ব্যাভিচার একটি অশ্লীল কাজ। মানুষ লজ্জা-শরম ও মনুষ্যত্ব থেকে বঞ্চিত হয়ে শয়তানের আতœপ্রবঞ্চনার শিকার হয়ে এ অনৈতিক ও পাশবিক কাজে জড়িয়ে পড়ে। ব্যাভিচারের কারণে সৃষ্টি হয় সামাজিক অনাসৃষ্টি, খুন খারাবী হত্যা ও হত্যার মত জঘন্য অপরাধ। যে যৌন শক্তি আল্লাহ পাক মানুষের বংশধারা সম্প্রসারণের জন্যে প্রদান করেছেন, তা যদি বিপথে বিনষ্ট করা হয় , তখন মানব সমাজে বিপর্যয় দেখা দেয়। চোখ কান খোলা রাখেন এমন ব্যক্তির জন্য তা আর খুলে বলার প্রয়োজন বলে মনে করছি না। আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেন-
وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلًا (৩২)
আর তোমরা ব্যাভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ। (সূরা ইসরা -৩২)
আল্লাহ তাআলা সফলকাম মুমিনের পরিচয়ে সূরা মুমিনের (৫-৬) নং আয়াতে বলেন-
وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُونَ (৫) إِلَّا عَلَى أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِينَ (৬)
(তরজামা) এবং যারা নিজেদেও যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে। তবে তাদের স্ত্রী ও মালিকানাভুক্ত দাসীদের ক্ষেত্রে সংযত না রাখলে তারা তিরস্কৃত হবে না।
মোটকথা বিবাহিত স্ত্রী অথবা শরীয়াত সম্মত দাসীর সাথে শরীয়াতের বিধি মোতাবেক কামপ্রবৃত্তি চারিতার্থ করার আর কোন হালাল পথ নয়। তাই ইসলামে বিবাহ পূর্ব প্রেম-প্রীতি সম্পূর্ণরূপে হারাম। এর পরিণাম ভয়াবহ হয়ে থাকে। এ অভিশপ্ত অপরাধ নির্মূলের জন্য ইসলাম অনেক ব্যাবস্থা পত্র দিয়েছে। নিম্নে তার কিয়দাংশ উল্লেখ করা হলো।
১. তাকওয় অর্জনের মাধ্যমে সমাজকে অপরাধমুক্ত রাখার প্রচেষ্টা। ২.পর্দা রক্ষা করে চলার নির্দেশ দিয়ে। ৩. লজ্জাবোধের নির্দেশ দিয়ে। ৪.দৃষ্টি সংযত রাখার নির্দেশ দিয়ে। ৫.জাহেলী যুগের ন্যায় উগ্র পোশাকে চলাফেরা না করার নির্দেশ দিয়ে। ৬. দেহাবয়বের সৌন্দর্য প্রকাশ না করার নির্দেশ দিয়ে। ৭. নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বর্জনের নির্দেশ দিয়ে। ৮. সহশিক্ষার পদ্ধতি পরিহার করার বিধান আরোপ করে। ৯. কোন পুরুষের সাথে একান্ত সাক্ষাতের ব্যাপারে নিষাধাগ্ঞা আরোপ করে। যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি করে এমন বিষয় থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ দিয়ে। ১০. শাস্তিদানে কঠোরতার মাধ্যমে। অবিবাহিত কেউ ব্যাভিচার করলে তার শাস্তি হল ১০০ চাবুক। আর বিবাহিত কেউ ব্যাভিচার করলে তার শাস্তি হল সঙ্গেসার বা প্রস্তারাঘাতে মৃত্যুদ-। ইরশাদ হয়েছে
الزَّانِيَةُ وَالزَّانِي فَاجْلِدُوا كُلَّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا مِائَةَ جَلْدَةٍ وَلَا تَأْخُذْكُمْ بِهِمَا رَأْفَةٌ فِي دِينِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَلْيَشْهَدْ عَذَابَهُمَا طَائِفَةٌ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ (২)
যিনাকার পুরুষ ও মহিলা তাদের প্রত্যেককে একশত দুররা মার। আল্লাহর বিধান কার্যকর করার ক্ষেত্রে তাদের প্রতি কোনরূপ অনুকম্পা যেন তোমাদেরকে স্পর্শ না করে। যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী হও। (সূরা নূর:৩)
উল্লেখ্য যে এ বিধান কার্যকর অধিকার রয়েছে একমাত্র রাষ্ট্রের। ব্যক্তিগত বা সামাজিক উদ্যেগে এ শাস্তি প্রয়োগ করা যাবে না।
ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে সুবিবেচক, মহাজ্ঞানী ও সর্বজ্ঞ হিসাবে মহান আল্লাহ্ তাআলা তদীয় বিধানে মানুষের জীবনকে সাবলীল, গতিশীল, সৌন্দর্যমন্ডিত ও শান্তিপূর্ণ করে তোলার জন্য এবং মানুষের নৈতিক, আধ্যাত্মিক, জ্ঞানগত ও জাগতিক বিকাশের জন্য প্রত্যেক মানুষকে তার ব্যক্তি জীবন, সামাজিক জীবন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে কতিপয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেছেন। এই সুযোগ-সুবিধার সমষ্টিকেই ইসলামে অধিকার বলা হয়। ১. যেসব সুযোগ সুবিধা একান্ত ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনের সাথে কিংবা এক ব্যক্তির সঙ্গে অন্য ব্যক্তির সম্পর্কের সাথে সংশ্লিষ্ট সেগুলোকে বলা হয় হক্কুল ইবাদ। ২. এমন হক ও অধিকার যার সুফল কোন ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের জন্য নির্ধারিত নয়। বরং তার সুফল সমগ্র মুসলমান (তথা মানুষ) ভোগ করে কিংবা মানব সম্প্রদায়ের কোন একটি বিশেষ শ্রেণী ভোগ করে। আবার সকল মানুষের জন্যই তা প্রয়োজনীয় ও কাম্য। এ ধরণের অধিকারকে শরীয়াতের পরিভাষা হক্কুল্লাহ কিংবা আল্লহর হক বলা হয়ে থাকে। লক্ষ্যনীয় যে সমাজের সাথে সংশ্লিষ্ট সুযোগ সুবিধার গুরুত্বের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করার জন্য ইসলামে সেগুলোকে হক্কুল্লাহ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যাতে এগুলোর ক্ষেত্রে কেউ সীমা লঙ্ঘন করতে দুঃসাহসী না হয়ে উঠে। (আধুনিক রাষ্ট্র বিজ্ঞান ও ইসলাম ৪৮৮)
উপরোক্ত দৃষ্টিকোণ থেকে যিনার বিষয়টি বিবেচনা করলে বুঝা যায় যে, এ অপরাধটি যদিও বান্দার হকের সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত নয় কিন্তু এ অপরাধটি এমন অনেক অপরাধ সঙ্গে নিয়ে আসে যার দ্বারা বান্দার হক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং হত্যা ও লুটতরাজের হাঙ্গামা সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ এ অপরাধটি যেমন জনক্ষতিকর কাজ তেমনি হিংস্র প্রকৃতির পাপ কাজ। একারেই ইসলাম এ অপরাধকে সব অপরাধের চেয়ে গুরতর বলে সাব্যস্ত করেছে এবং এর শাস্তিও সব অপরাধের শাস্তির চেয়ে কঠোর বিধান করেছে। কেননা এটি এমন একটি অপরাধ যা অন্যান্য শত শত অপরাধকে নিজের মধ্যে সন্নিবেশিত করেছে।
নিজের কৃতকর্মের উপর লজ্জিত হয়ে ভবিষ্যতে যিনা না করার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়ে আন্তারিকভাবে তওবা করতে হবে। গুণাহ যতই হোক না কেন নিয়মমত মত তওবা করিলে মাফ পাওয়া সম্ভব।
আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেন-
إِنَّمَا التَّوْبَةُ عَلَى اللَّهِ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السُّوءَ بِجَهَالَةٍ ثُمَّ يَتُوبُونَ مِنْ قَرِيبٍ فَأُولَئِكَ يَتُوبُ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَكَانَ اللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا (১৭)
অবশ্যই আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করবেন, যারা ভুলবশত মন্দ কাজ করে অত:পর অনতিবিলম্বে তওবা করে এরাই সেসব লোক যাদেরকে আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ মহাজ্ঞানী রহস্যবিদ। (সূরা নিসা-১৭)
হযরত আনাস রা. বর্ণনা করেছেন যে,
سمعت رسول الله صلى الله عليه و سلم يقول قال الله يا ابن آدم إنك ما دعوتني ورجوتني غفرت لك على ما كان فيك ولا أبالي يا ابن آدم لو بلغت ذنوبك عنان السماء ثم استغفرتني غفرت لك ولا أبالي يا ابن آدم إنك لو أتيتني بقراب الأرض خطايا ثم لقيتني لا تشرك بي شيئا لأتيك بقرابها مغفرة
আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়ামকে বলতে শুনেছি তিনি বলেন- হে আদম-সন্তান, যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি আমার নিকট দোআ করতে থাকবে এবং আমার নিকট আশা করতে থাকবে তোমার যত গুণাহই হোক না কেন, আমি তা মাফ করে দিব এবং আমি কারো পরোয়া করি না। হে আদম-সন্তান, তোমার গুণাহ যদি আকাশের মেঘমালা পর্যন্ত পৌছে যায়, অতঃপর তুমি আমার নিকট ক্ষমা চাও , তবে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিব। এবং আমি কারো পরোয়া করি না। হে আদম-সন্তান, তুমি যদি আমার নিকট এই পরিমাণ গুণাহ নিয়ে হাযির হও যা দ্বারা সমস্ত পৃথিবী ভরে যায়, কিন্তু তুমি আমার নিকট এই অবস্থায় আস যে, কউকেই আমার সাথে শরীক করো নাই, তবে আমি তোমাকে এই পরিমাণ ক্ষমা দান করব যা দ্বারা সমস্ত পৃথিবী ভরে যায়। (তিরমিযী শরীফ- হাদীস নং ৩৫৪০)
হযরত আয়শা রা. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন –
إن العبد إذا اعترف ثم تاب تاب الله عليه
বান্দা নিজ কৃত গুনাহের কথা স্বীকার করে যদি তওবা করে তাহলে আল্লাহও তার তওবা কবুল করেন। (বুখারী ও মুসলিম)
এতএব প্রশ্নে উল্লেখিত ব্যক্তিদ্বয়ের কৃত কর্মের জন্য অনতিবিলম্বে তওবা করা ও বেশি বেশি ইস্তেগফার পাঠ করা আবশ্যক। কোন আহলে দিল আল্লাহ ওয়ালা বুযুর্গ ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলবে তাহলে সব রকমের গুনাহ থেকে বাচা সহজ হবে ইনশাআল্লাহ। এছাড়া আরেফ বিল্লাহ হাকীম আখতার রহ. লিখিত ‘আতœার ব্যাধি ও তার প্রতিকার’ এবং গবেষক আলেমে দ্বীন মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া লিখিত ‘ইসলাম ও যৌনবিধান’ গ্রন্থ দুটির অধ্যায়ন অনেক ফলোদয় হবে বলে আশা রাখি।
উল্লেখ্য যে, উক্ত নারীর সাথে বৈধভাবে বসবাস করতে চাইলে শরয়ী পদ্ধতিতে তাকে বিবাহ করে ঘর সংসার করার ও সুযোগ রয়েছে।
وأنها واجبة على الفور لايجوز تأخيرها سواء كانت المعصية صغيرة أوكبيرة ( كتاب التوبة – شرح مسلم للامام النووى)
ج 2 رجل تزوج حاملا من زنا منه فالنكاح صحيح عند الكل ويحل وطؤها عند الكل، شلبى على الزيلعى ص 133
فصل فى المحرمات ، مكتبة امدادية باكستان، البحر الرائق 3: 106 فصل فى المحرمات الدر المختار على الشامى زكريا 4: 142 فصل فى المحرمات
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
মাওলানা মুহসিনুদ্দীন খান
গবেষক- তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
@কপিরাইট: http://ahlehaqmedia.com/2300-2/
Application Download Link: https://play.google.com/store/apps/details?id=com.tos.masayel