কুকুর কাহিনী

in #dog3 years ago

নেকড়ে থেকে কুকুরের বিবর্তনের ছবিটা এখনো অস্পষ্ট। কত বছর আগে মানুষ পোষ মানিয়েছিল কুকুরদের? প্রাচ্যে না পাশ্চাত্যে — কোথায় প্রথম কুকুরের নমনীয় স্বভাব দেখা গেছিলো? বিবর্তনের ধারা একটাই নাকি বারকয়েক পোষ মানাতে হয়েছিল এদের? জিনগতভাবে দেখলে নেকড়ের সাথে এদের তফাৎ কোথায়? এইসব প্রশ্ন নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে গতকয়েক বছরে।

কুকুরের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অন্তত ১৫,০০০ বছর পুরনো। নানারকম জীবাশ্ম (fossil) ও জিনগত (genetic) সূত্র থেকে এটুকু পরিস্কার যে কুকুরদের পূর্বপুরুষ নেকড়ে (gray wolf) জাতীয় কোনো শ্বদন্তক (canid) প্রাণী। ঠিক কবে আর কিভাবে নেকড়ে থেকে কুকুরে রূপান্তর ঘটেছে তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলছে পৃথিবী জুড়ে।

কুকুরের বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে মানুষের “ভাষা” বোঝার, মানুষের নানা অঙ্গভঙ্গি বুঝে সেইমত কাজ করার । পোষা কুকুর ছুঁড়ে দেওয়া বল মুখে করে নিয়ে আসে, সকালবেলা খবরের কাগজ মুখে নিয়ে এসে মালিককে দেয়, বসতে বললে বসে, শুতে বললে শোয়, এসব আমাদের জানা কথা। কুকুর যাঁরা ভালোবাসেন তাঁরা এক কথায় স্বীকার করবেন যে কুকুরের চোখের দিকে তাকালে তাঁদের মন গলে যায়, কুকুররা তাঁদের সঙ্গে যেন কথা বলে। পোষা কুকুরের চোখের দিকে তাকিয়ে তার অভিভাবকের এমন মনে হওয়া আশ্চর্য্যের নয়, কিন্ত রাস্তার নেড়ি কুকুর? তাদের দেখেও তো মানুষের দয়া হয়, মন গলে, মনে হয় “আহা বেচারা, বড্ড খিদে পেয়েছে ওর!” এই দয়ার জন্যই এতকাল ধরে টিঁকে রয়েছে হয়ত কুকুরেরা, হয়ে উঠেছে মানুষের সবচেয়ে প্রিয় প্রাণী, সবসময়ের সাথী।

নেকড়ে থেকে কুকুর
বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের ভাষা বোঝার, এবং মানুষের সঙ্গে মানসিক যোগস্থাপন করার ক্ষমতার মধ্যেই রয়েছে কুকুরের বিবর্তনের চাবিকাঠি। মানুষের ভাষা বোঝার, মানুষের সঙ্গে ভাবের আদানপ্রদান করার এই ক্ষমতাকে বলা হয় social cognition। বিভিন্ন রকম আচরণভিত্তিক ও মনস্তত্বভিত্তিক পরীক্ষার মাধ্যমে জানা গেছে যে নেকড়েদের তুলনায় কুকুরদের এই ক্ষমতা অনেক বেশী। কুকুর বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে অতীতে কোনো এক সময় নেকড়ে বা নেকড়ে জাতীয় কোনো পশু মানুষের সঙ্গে আদানপ্রদান করতে শুরু করে, এবং যাদের মধ্যে এই social cognition বেশী প্রবল, তারা মানুষের সঙ্গে সহজে মানিয়ে নিতে শেখে। কুকুরের এই পূর্বসূরিরা আমাদের পূর্বপুরুষদের আশেপাশে থেকে তাদের উচ্ছিষ্ট খেতে শুরু করে, স্বাভাবিক নেকড়েসুলভ হিংস্রভাব তাদের আচরণে কমে যেতে থাকে, তারা হয়ে ওঠে সহজবশ্য, পোষ মানে ক্রমশ। এই ধারণার নাম দেওয়া হয়েছে domestication hypothesis। এর মূল ভাব পোষ মানানো হলেও তফাৎ হল যে এখানে মানুষ কুকুরকে ঠিক নিজের প্রয়োজনে জোর করে বেঁধে রেখে পোষ মানায় না, কুকুর নিজেই পোষ মানতে ইচ্ছুক। এতে অবশ্য লাভ উভয়পক্ষেরই। সমস্যা হল যে কুকুরের বিবর্তনের ইতিহাস বোঝার জন্য বেশীর ভাগ গবেষণা করা হয় পাশ্চাত্যে, পোষা কুকুর নিয়ে। নানা জাতের পোষা কুকুর আমাদের চোখে যতই আলাদা হোক, একটি german shepherd এর সঙ্গে একটি poodle এর জিনে আসলে খুব তফাৎ নেই। প্রায় ৩৫০টি কুকুরের breed ছড়িয়ে রয়েছে সারা পৃথিবীতে, এবং এরা সকলেই প্রায় মানুষের সৃষ্টি; ঠিক যেভাবে আমাদের যাবতীয় খাদ্যশস্য এবং গৃহপালিত পশু আমাদের সৃষ্টি, artificial selection পদ্ধতিতে। কুকুরের breed তৈরিতে মানুষের হাত থাকলেও, নেকড়ে থেকে কুকুরের বিবর্তন ঘটেছে এই কৃত্রিম প্রজনন আরম্ভ হওয়ার অনেক আগে। অর্থাৎ, ছবিটা কিছুটা এই রকম –

পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে কুকুরের জিন সংগ্রহ করে কুকুর নামক প্রাণীটির বিবর্তনের ইতিহাস বুঝতে চেষ্টা করছেন নানা দেশের বৈজ্ঞানিকরা। গত কয়েক বছর ধরে কিছু নতুন প্রকাশিত তথ্য কুকুরের বিবর্তনের ইতিহাস কিছুটা হলেও পরিস্কার করেছে, যদিও এখনো অনেক প্রশ্ন রয়েছে। প্রথমে বলি কি কি জানা গেছে, সেই কথা, তারপরে ফিরব প্রশ্নে।

প্রাথমিক গবেষণা
কুকুরের বিবর্তনের বিষয়ে প্রথম বৈজ্ঞানিক কাজের নিদর্শন হিসেবে হয়ত ধরে নেওয়া যায় ১৯৬১-তে প্রকাশিত Magnus Degerbøl নামক এক ড্যানিশ বৈজ্ঞানিকের কাজ [১]। তবে কুকুরের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের প্রথম প্রমাণ প্রকাশিত হয় ১৯৭৮-এ Nature journal-এ তিন পাতার একটি গবেষণাপত্রে [২]। ইসরায়েলের Davis ও Valla জানান যে মধ্য-প্রাচ্যের নাতুফিয়ান সংস্কৃতির (Natufian culture) এলাকার একটি বাসস্থানে একটি পাথরের নীচে একজন বয়স্ক মানুষের প্রায় আস্ত কঙ্কাল পাওয়া গেছে। এই মানুষটি পা মুড়ে শুয়ে রয়েছেন, একটি হাত মাথার ওপরে একটি কুকুর (অথবা নেকড়ে) ছানার গায়ে রাখা। বোঝা যায় যে এই স্বাপদশিশুকে কবর দেওয়া হয়েছিল তার “মালিকের” সঙ্গে। একই সঙ্গে আরো কিছু হাড় পাওয়া যায় ওই নাতুফিয়া এলাকা থেকে। ১৯৭৮-এ এখনের মত DNA analysis ছিল না, সুতরাং এই হাড়গোড়গুলি নানাভাবে মেপে, অন্যান্য কুকুর ও নেকড়ের হাড়ের সঙ্গে তুলনা করাই ছিল একমাত্র পদ্ধতি। এই কাজ থেকে পরিষ্কার হয়নি ওই হাড়গুলি কুকুরেরই ছিল কিনা, তবে ১২,০০০ বছর আগে নাতুফিয় আমলে যে কুকুরজাতীয় পশুকে মানুষ পোষ মানিয়েছিল তার সাক্ষী ১৩১ নম্বর বাসায় পাওয়া ওই কবর।

কাট টু ১৯৯৭, মার্কিন ও সুইডিশ বৈজ্ঞানিকদের কাজ থেকে প্রমাণিত হল যে নেকড়ে থেকেই কুকুরের উৎস [৩]। Science পত্রিকায় Robert K. Wayne এবং তাঁর সহকর্মীদের কাজ প্রকাশিত হয়; ৬৭টি ব্রীডের ১৪০টি পোষা কুকুর ও পৃথিবীর ২৭টি জায়গার ১৬২টি নেকড়ের mitochondrial DNA পরীক্ষা করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছন তাঁরা। সেই সঙ্গে জানা যায় যে অন্ততপক্ষে ১০০,০০০ বছর আগে কুকুর বিবর্তিত হয়েছে নেকড়ের থেকে, এমনকি, কুকুরের প্রথম আবির্ভাব ১৩৫,০০০ বছর আগেও ঘটে থাকতে পারে। সমস্যা হল যে, আদিম মানুষের আশেপাশে কুকুরের যে সমস্ত চিহ্ন পাওয়া গেছে, সেগুলির বয়স অত নয়। তারও আগে যদি কুকুরের অস্তিত্ব থেকে থাকে, তাহলে আমরা তার কোনো চিহ্ন পাইনি