গ্রেস কটেজ
নমস্কার বন্ধুরা। আশা করছি আপনারা সকলে সুস্থ আছেন। আজ আমি আপনাদের সকলের সাথে শেয়ার করতে চলেছি আমাদের শহরেরই একটি জায়গার কথা এবং সে জায়গা সংক্রান্ত ইতিহাস।ডিসেম্বরের ৩ তারিখে আমাদের কৃষ্ণনগর গ্রেস কটেজে চারুকলা সোসাইটি থেকে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। আজকের পোস্টে আমি গ্রেস কটেজ এর ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করছি।
আমাদের কৃষ্ণনগর শহর ঐতিহ্য এ পরিপূর্ণ। কৃষ্ণনগরের কোণায় কোণায় নানা ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে। আমার মনে হয় প্রত্যেকটি শহরেরই নিজস্ব ইতিহাস আছে। তবে কৃষ্ণনগর ব্রিটিশ আমলের এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের এক বিরাট সাক্ষী । এর সাথে কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল অর্থাৎ মৃৎশিল্প তো আছেই।
কৃষ্ণনগর শহরে বহু স্বনামধন্য লেখক লেখিকা জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এই শহরের মাটিতে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আগমন ঘটেছে বহুবার। এবং শহরে তরফ থেকে এই সমস্ত কিছুকেই আগলে রাখার এবং যত্ন সহকারে ঠিকঠাক ভাবে রাখার চেষ্টা করা হয়। তেমনই একটি জায়গা হল গ্রেস কটেজ। বর্তমানে কৃষ্ণনগর ইলেকট্রিক সাপ্লাই অফিসের মধ্যেই অবস্থিত এই ছোট্ট একতলার বাড়ি গ্রেস কটেজ নামে পরিচিত। বাড়ির সামনে একটি খোলা বারান্দা আর মোটামুটি চার পাঁচটি ঘর নিয়ে এই বাড়িটি এখনো ঠাঁই দাঁড়িয়ে আমাদের সকলকে নিজের ইতিহাসের জলজ্যান্ত স্বরূপ হিসেবে তুলে ধরে আছে।
এই পৃথিবীতে বহু কিছু ঘটে গেছে। প্রত্যেক সময় নানান কিছু ঘটে চলেছে। মানুষ আজ আছে কাল নেই। কিন্তু এই শহরতলী এবং এই পুরনো করিবর্গার ছাদ বিশিষ্ট বাড়িগুলি সমস্ত অজানা না বলা তথ্য ধরে রাখে। বাড়ির দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে বেড়ে ওঠা প্রত্যেকটি গাছের চারা যত বড় হয়, ততো আভিজাত্য বাড়তে থাকে সেইসব জায়গার । এরকম কত কত ঘরবাড়ি লোকানো,কত নাম না জানা, অজানা ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে , তার খবর হয়তো আমরা কেউ রাখতেও যাই না।
গ্রেস কটেজ জায়গাটি সেই রকমই হার হিম করে দেওয়া একটি জায়গা। এই জায়গায় আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তিন বছর নিজের পরিবারের সাথে অতিবাহিত করেছিলেন। এ জায়গায় ওনার পুত্র জন্ম গ্রহণ করেছেন। আমি যতবার এই বাড়িতে পা রাখি ,আমার ভাবলেই অবাক লাগে , গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে , আমি অনুভব করতে পারি সেই বাড়িটির কতটা তাৎপর্য। অনুভব করতে পারে আমার মতনই আরো কয়েক মানুষ যারা বর্বর নয়, শিক্ষিত এবং মানবিক ।
স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে প্রচুর মানুষ সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। যে যেভাবে পেরেছে, চেষ্টা করেছে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন এমনই একজন, যিনি নিজের লেখার মাধ্যমে দেশের চারিদিকে প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে প্রতিবাদী চেতনার জাগরণ ঘটিয়েছিলেন। তার লেখায় এখনো সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি সুস্পষ্ট। এখনও লেখা পড়লে শরীরের মধ্যে এক আলাদা শিহরণ কাজ করে। তরুণ দলকে প্রতিবাদের আগুনে উজ্জীবিত করার জন্য কবি লিখেছিলেন -
"কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট,
রক্ত-জমাট শিকল পূজার পাষাণ-বেদী..
ওরে ও তরুণ ঈশান..
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ,
ধ্বংস-নিশান উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি.."
ব্রিটিশ আমলে স্বাধীনতা সংগ্রামে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, দেশের জন্য স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে নিঃস্বার্থভাবে । সেই সব বিপ্লবীদের আমরা এখনো সম্মান জানাই, শ্রদ্ধা করি। অন্তত আমাদের শহর করে। আজ আমরা যে ভালো থাকছি ,স্বাধীনভাবে নিশ্চিন্তে বেঁচে আছি, তার পিছনে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অবদান সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব রাখে। তাই প্রত্যেকটি মানুষেরই উচিত তাদেরকে শ্রদ্ধা করা। আমার তো মনে হয় এই শ্রদ্ধা নিজের ভেতর থেকে আসে। যারা শিক্ষিত, মানবিক তারা বিষয়ের গুরুত্ব বোঝে।
আমি খুব গর্বিত আমি আমার শহরের বাসিন্দা। কৃষ্ণনগরের বহু জায়গায় বিভিন্ন সংস্থা গড়ে উঠেছে। শহরকে শিল্প সংস্কৃতিতে বাঁচিয়ে রাখতে এই সংস্থাগুলি গোটা বছর ধরে কাজ করে চলে। তার মধ্যে একটি হলো সুজন বাসর। সুজন বাসর সংস্থাটি একটি সংস্কৃতিক সংস্থা। সুজন বাসরের উদ্যোগে সুজন পাঠাগার এবং নজরুল গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। এদের হাত ধরে এই বাড়িটির সমস্ত রকম তথ্য এবং ইতিহাস হেরিটেজ অফিসে পৌঁছায়। এবং তারপরে বাড়িটি সংস্কার করা হয় হেরিটেজ দপ্তর থেকে। বর্তমানে এখন এই গ্রেস কটেজ হেরিটেজ ভবন হিসেবে ঘোষণা করেছে পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন।
আজকের মত এখানেই শেষ করছি। গ্রেস কটেজের অনুষ্ঠান নিয়ে আমি পরবর্তী পোস্টে আলোচনা করব।