মাতৃভাষা বাংলাভাষা আজ কি বিপন্ন? একটি সার্বিক আলোচনা।
মাতৃভাষা বিষয়ক একটি আলোচনা
খুব প্রচলিত একটি বিষয় নিয়ে আজকে আলোচনা করব। আজকের সমাজে এই আলোচনাটা হয়তো ভীষণ প্রয়োজন।
আজ একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করব। বিষয়টি খুবই চিন্তা বাড়ায় এবং ধীরে ধীরে এক আশঙ্কার দিকে নিয়ে যায়। আমরা আসলে এক অদ্ভুত যুগে বাস করছি। এই যুগে দাঁড়িয়ে কোন ভাষায় কথা বলব সেটা বুঝে উঠতেই অনেক সময় কেটে যায়। এই ধরুন একটা কাজে কলকাতা গেছি। শিয়ালদা স্টেশনের আশেপাশে অথবা হাওড়া স্টেশনে প্লাটফর্মের উপরে এখন নিজের কলকাতা শহরকে চিনতেই অসুবিধা হয়। কারণ? জানতে চান কারণটা? কেন আপনি কি বুঝতে পারেননি? কারণটা একমাত্র ভাষাগত। বর্তমান সময়ে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা রীতিমতো বিপন্ন পরিস্থিতিতে অবস্থান করছে এ কথা বলতে কোনো বাধা নেই। বাংলা ভাষার মান ধরে রাখতে আমরা কতটা আগ্রহী তা যেন নিজেকেই প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে বারবার। কখনো দক্ষিণ কলকাতার কোন শপিংমলে গেছেন? খুঁজে দেখবার চেষ্টা করবেন তো আজকালকার ক'জন ছেলে মেয়ে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলে। পেলেও হয়তো হাতে গোনা।
আসলে বাংলা ভাষার প্রতি মানুষ দিনে দিনে আগ্রহ হারাচ্ছে। বর্তমান প্রজন্ম এই ভাষাতে কথা বলতে সাবলীল নয়। এমনকি স্কুলে কাজ করার জন্য বহুদিন ধরে দেখে আসছি বাংলা ভাষা নিয়ে পড়াশোনা করতেও সকলের প্রচুর অনীহা। তার থেকে বরং বাঙালির ছেলে হিন্দি পড়বে, সেটা যেন অনেক প্রেস্টিজের। আর ইংরেজি হলে তো কথাই নেই। কলকাতা শহরের রাজপথে যদি দু এক পিস ইংরেজি বলা যায়, তবে আর আপনাকে পাই কে? ধারে ও ভারে আপনি তখন রাস্তার রাজা।
আচ্ছা ভেবে দেখেছেন কেন এমন হলো? আজ থেকে দশ বছর আগেও পরিস্থিতি এতটা খারাপ ছিল কি? তখনও কলকাতার রাস্তায় সিংহভাগ মানুষ কথা বলত বাংলায়। কিন্তু বর্তমানে মানুষের বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহ হারাবার কারণ কি? একদিন পর্যালোচনা করতে বসেছিলাম। ভেবে দেখলাম মানুষ কিছুটা বাধ্য হয়েই বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। আসলে বহু ভাষা প্রচলিত এই দেশে মানুষের দীর্ঘকালীন পর্যায়ে বাংলা ভাষা ব্যবহারের বিভিন্ন অসুবিধা দেখা যাচ্ছে। এটা শুধু বাংলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। মহারাষ্ট্রের বাইরে মারাঠি ভাষা কি চলে? ফলে সেখানকার রাজধানী মুম্বাইতেও সিংহভাগ কথাবার্তা হিন্দিতেই হয়। এমনকি আমি হায়দ্রাবাদে গিয়ে মানুষের মুখে শুদ্ধ হিন্দি বলতে দেখেছি। তাই বাংলা ভাষা বিপন্ন এটা আমি পুরোপুরি মানতে পারি না। কিন্তু ভাষাটার আরও নিরাপত্তা দরকার সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বাঙালির ছেলে বা মেয়েরা কলকাতার বুকে বাংলা ভাষায় কথা বলছে না এটা একটু হাস্যকর বটে। অবাঙালি যে হিন্দি বলবে সে বিষয়টা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তা বলে বাঙালিরাও!! আসলে তাদের দোষই বা কোথায় বলুন তো। জন্ম থেকে যদি ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে হিন্দি এবং ইংরেজি বলে মানুষ হয়, তবে তারা মাতৃভাষা হিসেবে কোন ভাষা কে শিখছে? মাতৃভাষা শিক্ষাও আজ মানুষের কাছে বাধ্যতামূলক নয়। এখানে ব্যবস্থায় আপনি কিভাবে আশা করেন একজন বর্তমান শিশু শুদ্ধ বাংলায় কথোপকথন পরিচালনা করবে? মূল যদি শক্ত না হয়, তবে গাছ কিসের উপর দাঁড়াবে?
আমরা যতই বাংলা ভাষার বিপন্নতা নিয়ে চিৎকার করি না কেন, সমাজ চলবে সমাজের গতিতেই। একটা ভাষা তখনই মৃত বলে ঘোষণা হয়, যখন সেই ভাষার আর কোন ব্যবহারকারী থাকে না। ঠিক যেভাবে ভারতবর্ষে লুপ্ত হয়ে গেছে সংস্কৃত ও পালি ভাষা। এছাড়াও আরও বিভিন্ন উপভাষা ভারতবর্ষের মাটি থেকে মুছে গেছে বহু আগেই। বাংলা ভাষার মতো একটা গুরুভাষা কি এভাবে মুছে যাবে শুধুমাত্র যত্নে লালন না করার অপরাধে? তাই প্রত্যেকটি শিশুর কাছে মাতৃভাষা শিক্ষার যে গুরুত্ব তা অপরিসীম। মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ। এই কথা আমরা শিখেছি ছেলেবেলা থেকেই। তাই অন্তত কলকাতার মাটিতে দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষাটাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হলে সঠিক শিক্ষার ভীষণ প্রয়োজন।
ইংরেজি বলা এখন স্ট্যাটাসের মানদন্ড। এখানে পরিস্থিতিতে বাংলা ভাষা যেন চরমভাবে অবহেলিত। এমনকি আমি এমনও দেখেছি, যে বাংলা ভাষা ব্যবহার করবার জন্য অপমানিত হতে হয়েছে অনেক মানুষকে। আজও হয়ে চলেছে এমন ঘটনা। তাই যতদিন না আমরা নিজেদের ভাষাটার দিকে মন দেব, ততদিন কখনোই সেই ভাষার প্রকৃত ব্যবহার হবে না এই সমাজে। শুধুমাত্র মুখে বললেই সেই ভাষাটি বেঁচে থাকেনা। তার জন্য দরকার যথেষ্ট পরিমাণে পড়াশোনা এবং ব্যাকরণশিক্ষা, আজকালকার দিনে যা বড়ই অভাব।
তাই ভাষার বিপন্নতা নিয়ে চিৎকার না করে আসুন ভাষাটাকে লালন করি। সঠিক ভাবে ভাষাকে লালন করাই একটি ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখবার পথ। তাই আজকালকার যুগে সব ভাষার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে যথাযোগ্য গুরুত্ব দিয়ে তাকে মর্যাদায় উত্তরণ ঘটানোই আমাদের প্রত্যেকের উচিত। বাংলার বুকে বাঙালি বাংলা ভাষা জানবে না, এ কোন কাজের কথা নয়। তাই আসুন আমরা আজ থেকেই শুরু করি এই মাতৃভাষা অভিযান। বলছি না অন্য ভাষা থাকবে না। কিন্তু সবের মধ্যে মাতৃভাষা হিসেবে গুরুত্ব পাক আমাদের প্রাণের বাংলা।
🙏 ধন্যবাদ 🙏
(১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
আজকের টাস্ক -
https://x.com/KausikChak1234/status/1862204407225385426?t=TaDd8geEKs7VqqrD6h_HKQ&s=19
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
ব্যাপার টা যেমন দুঃখজনক তেমনি ভয়ের। এর আগে পশ্চিমবঙ্গের একজন অভিনেতার মুখে শুনেছিলাম ওখানে এখন অধিকাংশ মানুষ নাকী হিন্দি না হয় ইংরেজিতে কথা বলে। বাংলা এখন শুধুমাত্র একটা অচল ভাষা। এটা সত্যি ভয়ের ব্যাপার। এমন চললে ভবিষ্যতে হয়তো বাংলা ভাষার বিলুপ্তি হতে পারে।
হ্যাঁ ভাই। আসলে বাংলা কিছুটা আগ্রাসনের শিকার। তবে আমরা থাকতে ভাষাকে বিপন্ন হতে দেব না এটুকু বলতে পারি। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা ভাষার উপর গঠিত একটি রাজ্য। সেখানে বাংলা ভাষাই প্রধান ভাষা হিসেবে থাকবে।