স্মৃতিচারণ-"শৈশবের শীতের সকাল এবং ছোট কাকার সাথে পুকুরে গোসল"
শীতের সকাল মানেই কুয়াশায় মোড়ানো চারপাশ। সূর্যের আলো কুয়াশা ভেদ করে ধীরে ধীরে মাটি ছুঁয়েছে কি ছুঁয়েছে না, তখনই ছোট কাকা ডাক দিতেন, “এই, ওঠ! চল পুকুরে।” প্রথমে মনে হতো, এ কি অসম্ভব কাণ্ড! শীতের সময় পানিতে নামতে হবে? কিন্তু ছোট কাকার হাসি আর উৎসাহে কিছু বলতে পারতাম না।
আমার ছোট কাকা ছিলেন খুবই প্রাণবন্ত একজন মানুষ। তাঁর সবকিছুতেই যেন একটা খেলা লুকিয়ে থাকত। শীতকালটা তাঁর কাছে ছিল একরকম চ্যালেঞ্জ। আর পুকুরে গোসল ছিল তাঁর সেই চ্যালেঞ্জের বড় অংশ। আমাদের বাড়ির পুকুরটা ছিল বেশ বড়, গভীর আর পরিষ্কার। শীতকালে ঠাণ্ডা পানি যেন শরীরের প্রতিটি কোষকে জাগিয়ে তুলত।
সেদিনও ঠিক একই রকম সকাল। চারপাশ কুয়াশায় ঢাকা। আমি তখন লেপের নিচে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছি। ছোট কাকা দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন, “আর কত শুয়ে থাকবি? চল, আজ তোর জন্য নতুন কাণ্ড করব।” তাঁর কথায় অজানা উত্তেজনা জাগল। লেপ থেকে বের হয়ে মোটা সোয়েটার আর মাফলার গায়ে দিয়ে দাঁড়ালাম।
ছোট কাকা একটা বড় তোয়ালে নিয়ে আমাকে নিয়ে পুকুরের দিকে রওনা হলেন। পথে যেতে যেতে বললেন, “শীত মানেই ভয় নয়, এটা মজা করার সময়। দেখবি, পানিতে নামার পর কেমন শরীর গরম হয়ে যাবে।” আমি তখনও ভয়ে অস্থির, কিন্তু কাকার আশ্বাসে সাহস পেলাম।
পুকুরঘাটে পৌঁছে দেখি, কুয়াশার মধ্যে পুকুরের পানি টলমল করছে। কাকা প্রথমেই পানি হাতে নিয়ে ছিটিয়ে বললেন, “এটা হলো শীতের সাথে প্রথম আলাপ।” এরপর এক লাফে পানিতে নেমে গেলেন। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি, কী করে নামব! কাকা বললেন, “তুই শুধু প্রথম একবার পানিতে নাম। এরপর দেখবি, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
মনের সব সাহস জড়ো করে আমি পা বাড়ালাম। প্রথমে ঠাণ্ডা পানিতে পা ডুবতেই শরীর কাঁপতে শুরু করল। কিন্তু কাকার হাত ধরে পুরো পুকুরে নামার পর অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো। ঠাণ্ডাটা কেমন যেন অভ্যাস হয়ে গেল। কাকা বললেন, “দেখলি! বলেছিলাম না, ভয় পাস না।”
এরপর শুরু হলো আসল মজা। কাকা পানিতে ঢেউ তুলে দৌড়াদৌড়ি শুরু করলেন। আমি প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও পরে আমিও তাঁর সাথে যোগ দিলাম। কখনো পানিতে ডুব দিচ্ছি, কখনো কাকার ছোড়া পানির ঢেউ এড়ানোর চেষ্টা করছি। পুকুরের পানিতে আমাদের খেলা যেন শেষই হতে চাইছিল না।
গোসল শেষ করে ঘাটে উঠে দেখলাম, কাকা আগে থেকেই একটা মাটির হাঁড়িতে পানি গরম করে রেখেছিলেন। সেই পানি দিয়ে গোসল শেষ করে তোয়ালে মুড়িয়ে আমরা বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। বাড়িতে ফিরে মায়ের গরম ভাত আর আলুভর্তা যেন তখন সবচেয়ে বড় স্বস্তি। খাওয়ার সময় কাকা গল্প করছিলেন, কীভাবে তিনি ছোটবেলায় দাদার সাথে শীতের সকালে পুকুরে নামতেন। তাঁর গল্প শুনতে শুনতে আমি বুঝতে পারছিলাম, এই অভিজ্ঞতা আমার জীবনের স্মৃতির পাতায় চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে।
শীতের সকালে পুকুরে গোসল আমার কাছে শুধুই ঠাণ্ডা পানিতে নামার গল্প নয়। এটা ছিল সাহস, আনন্দ আর ছোট কাকার সাথে এক অনন্য সম্পর্কের গল্প। তাঁর সেই উচ্ছ্বাস আর উৎসাহ আমাকে আজও অনুপ্রাণিত করে। জীবনের যে কোনো ঠাণ্ডা পরিস্থিতি সামলানোর সাহস আমি সেই শীতের সকালগুলো থেকেই পেয়েছি।
আজ ছোট কাকা দূরে আছেন, জীবনের ব্যস্ততায় তাঁকে নিয়মিত দেখা হয় না। কিন্তু শীত এলেই পুকুরের সেই সকালগুলো আমাকে মনে করিয়ে দেয়, জীবনের শীতলতম মুহূর্তেও আনন্দ খুঁজে পাওয়া সম্ভব, যদি পাশে থাকে এমন একজন প্রিয়জন।
আজ এখানেই শেষ করছি। অন্য কোন একদিন ভিন্ন ধরনের কনটেন্ট নিয়ে আপনাদের মাঝে হাজির হব। ততক্ষন পর্যন্ত আপনারা সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, আল্লাহ হাফেজ।
X-Promotion
এই শীতের সকালে পুকুরে নামার কথা শুনেই তো ঠান্ডা লেগে যাচ্ছে। অবশ্য অনেককেই দেখি শীতের সময় পুকুরে সকালবেলায় গোসল করে। তাদেরও মনে হয় আপনাদের মতই অনুভূতি হয়। ঠিকই বলেছেন ভয়কে জয় করতে পারলেই ভালো। তাতে জয় নিশ্চিত। ভালো লাগলো আপনার ছোটবেলার মুহূর্ত পড়ে।
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আপু।
আপনার ছোটবেলার মুহূর্ত পড়ে খুব ভালো লাগলো। বেশ সুন্দর অনুভূতি শেয়ার করেছেন আপনি। জি ভাই ছোটবেলার শীতকালে পুকুরে গোসল করাটা বেশ সাহসের ব্যাপার। ধন্যবাদ আপনাকে পোস্টটি শেয়ার করার জন্য।
গঠনগুলো মন্তব্য করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া।
ভাই আপনার কাকার সাথে শীতের সকালে গোসল করার কথা গুলো পড়ে আমারও অনেক দিনের কথা মনে পড়ে গেল। সেই বিষয়টা আমি আপনাদের মাঝেএকদিন তুলে ধরব। তবে একটা কথা মানুষ অভ্যাসের দাস অভ্যাস করলে সব কিছুই সম্ভব।
একদম ঠিক বলেছেন ভাইয়া, মানুষ আসলে অভ্যাসের দাস।