হরিহরেশ্বর বিচ ও শিবাজী মহারাজের রায়গড় ফোর্ট ভ্রমণ পর্ব-২
প্রিয় আমার বাংলা ব্লগের বন্ধুরা,
সমস্ত ভারতবাসী এবং বাংলাদেশের বাঙালি সহযাত্রীদের আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
আশা করি আপনারা ঈশ্বরের কৃপায় সুস্থ আছেন, সব দিক থেকে ভালোও আছেন। আপনাদের সবার ভালো থাকা কামনা করে শুরু করছি আজকের ব্লগ।
গত পর্বে হরিহরেশ্বর বিচ ঘোরার গল্প করছিলাম। তবে এই ট্রিপের আসল উদ্দেশ্য হল রায়গড় ফোর্ট৷ তাই সকাল সকালই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। প্রায় তিন ঘন্টার রাস্তা। রাতে ভালো ঘুম হওয়ার ফলে আগের দিনের ক্লান্তি প্রায় নেই বললেই চলে। যাবার পথে আরও কয়েকটা জায়গা ঘুরে চললাম রায়গড়ের উদ্দেশ্যে। এই রাস্তা পাহাড়ি। প্রতিটা বাঁক অচেনা। হর্ণ না দিলে যেন কেউ কাউকে আঁচ করতে পারে না৷ মহারাষ্ট্রে আরব যেমন মনোরম তেমনি পশ্চিমঘাটও আকর্ষণীয়৷ যতদূর চোখ যায় পাহাড়ের লম্বা লম্বা সবুজ ঘাস বাদামী হয়ে ওঠার জীবনচক্রে পৃথিবীকে দেখিয়ে দিচ্ছে জীবন মৃত্যু সহজ চক্রাবর্ত৷ ঘন্টা তিনেকের রাস্তা হলেও পথে ব্রেকফাস্ট আর কয়েকটি জায়গায় দাঁড়ানোর ফলে রায়গড় পৌঁছাতে দুপুর দুটো বেজে গেল৷ হোটেলে জানলাম ফোর্ট যেতে হলে ভোর পাঁচটায় লাইন দিতে হবে৷ আজ তো সম্ভব না৷ তাই হোটেলেই ভাত খেয়ে রেস্ট নিলাম। বিকেলের দিক আসপাশটা একটু হেঁটেও দেখলাম। অচেনা রাস্তায় হাঁটলে অন্যরকম অনুভূতি হয়। অচেনা মানুষ৷ এখানে কাউকে আমি চিনি না আর কেউ আমাকেও চেনে না৷
বেশি দেরি করলাম না৷ সত্যিই ভোর ভোর গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম৷ ফোর্টে ওঠার দুটি রাস্তা হাঁটাপথ আর রোপওয়ে। আমরা রোপওয়েতে যাবো বলেই এই লাইন। রোপওয়ে খুলল ন'টায়। ওপরে পৌঁছোলাম প্রায় দশটা৷ রাতে ঠান্ডা হলেও বেলায় চাঁদিফাটা রোদ৷ দু' বোতল জল আর গাইড নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ফোর্টে ঢুকতেই জানলাম এদিকটা ফোর্টের পেছনদিন।
আর সোজাসুজি উলটো দিকে প্রবেশপথ৷ আমরা যেই পথে ঢুকেছিলাম তা মেনা দরওয়াজা। এটি বিশেষত রাণীদের যাতায়াত পথ ছিল। ঢুকেই শিবাজির ছয় রাণীর বিশাল বিশাল ছয়টি শোবার ঘর আর সাথে অ্যাটাচ বাথরুম। অবাক বিষয়! মাথার ছাদ ইংরেজ শাসনকালে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে এখন ছাদের রঙ নীল। ছয় রানীর কক্ষের সামনে প্রত্যেকের দাসীদের ঘর।
রাণী মার্গ শেষ হলে আমরা পৌঁছে যাই মহারাজের শয়নকক্ষে। সামনেই তাঁর ব্যক্তিগত বাথটাব। যার নিকাশি আজও পরিষ্কার৷ শয়নকক্ষের আরেক পাশেই শিবাজির রান্নাঘর, তারপর মন্ত্রীদের মিটিং হল আর শেষে দিওয়ানে খাস আর এখান থেকে দেখা যায় দুটি টাওয়ার। যেদিন তিনি রাজ্য জয় করে ফিরতেন সেদিন টাওয়ার সাজিয়ে দেওয়া হত প্রদীপের আলোয়। এখান থেকে বেরিয়ে গেলেই দিওয়ানে আম। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের মিটিং দরবার৷ সামনেই নগরখানা দরওয়াজা৷
গাইডের কথায় জানলাম এখানেই মহারাজার রাজ্যভিষেক হয়েছিল৷
এখান থেকে বামদিকে দেখা যায় একটি বাজারের ধ্বংসাবশেষ আর আরও দূরে পানিশমেন্ট পয়েন্ট; তাকমাক তক৷ বাজারে প্রায় তেতাল্লিশটা দোকান ছিল, মাড়োয়াড়ি থেকে গুজরাটি অনেক ব্যবসায়ীরাই ব্যবস্থা করতে এসেছিলেন। বাজারে লোকে যেত ঘোড়ায় চেপে৷ দোকানগুলির বিশেষত্ব হলো দোকানের সাথে সাথে একটি থাকার ঘর ও একটি গুদামঘরও ছিল।
ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের নিয়ম অনুযায়ী কোন দোকানদার তার দোকানে নিজের নাম বা পদবি খোদাই করতে পারবেন না৷ কিন্তু একজন ছিলেন যার নাম নাগাপ্পা শেঠ যিনি তাঁর দোকানের সামনে সাপের চিত্র খোদাই করিয়েছিলেন যাতের তাঁর দোকান বোঝা যায়৷
এখান থেকে সোজা পূর্বে ফোর্টের মন্দির। দুর থেকে দেখলে মনে হবে মসজিদ৷ আসলে মহারাজা জানতেন মুঘল রাজারা আক্রমন করবেই৷ কিন্তু মসজিদ দেখলে ক্ষতি করবে না। মন্দিরের সিঁড়িতে খোদাই করা আছে রায়গড় ফোর্টের আর্কিটেক্টের নাম- হিরোজী ইন্দুলকর৷ সামনেই শিবাজির স্মৃতিমন্দির।
এই রায়গড় ফোর্ট আসলে ইউরোপীয়দের তৈরি৷ একে প্রাচ্যের জিব্রাল্টরও বলা হয়৷ ১৬৫৬ সালে রাজা চন্দ্ররাও মোরের সাথে যদ্ধে জিতে এটি হাসিল করেছিলেন। ১৬৬২ সালে ফোর্টের অবস্থান ও নানান সুবিধা দেখে রাজধানী করার সিদ্ধান্ত নেন৷ গাইডের সাথে গল্প করে জেনে নিচ্ছিলাম ফোর্টের উত্তরে রয়েছে পালকি দরজা। যেটা মহারাজা ও তার কাফেলার যাতায়াত পথ ছিল। এই ফোর্টে তিনি প্রায় দশ বছর ছিলেন। জীবনের সব থেকে বেশিদিন এখানে কাটিয়েছেন। আর মৃত্যুও এখানেই ঘটেছিল। মারাঠা রাজ্যে শিবাজি মহারাজ যে অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ রাজা ছিলেন তা বোঝা যায় ফোর্টের অবস্থান দেখে৷ রাজ্যের বাকি পাঁচটা উল্লেখযোগ্য ফোর্ট এখান থেকে পরিষ্কার দেখা যেত৷ আর এতো ওপরে এমনই ব্যবস্থা তিনি করিয়েছিলেন যে কাউকেই কখনও জলকষ্টে ভুগতে না হয়৷ জানলাম এখনও রায়গড়ে জল কম পড়লে ফোর্ট থেকে জল নিয়ে সাপ্লাই করা হয়৷ মহারাজাকে নিরাপত্তার কথা জানান দিতে আর্কিটেক্ট বলেছিলেন এই ফোর্টে রাজার অনুমতি ছাড়া হাওয়া ঢুকতে পারে আর জল যেতে পারে। কিন্তু হীরাকানি নামে এক দুধ বিক্রেতা সেই প্রবাদ ভ্রমে পরবর্তন করে দিয়েছিল৷ গল্প শোনা যায় একদিন দুধ বিক্রি করে ফেরার পথে দরজা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বাড়িতে তার দুধের শিশু। রাজার অনুমতি নেই। দরজাও খোলা নেই। বিপদ মাথায় নিয়ে হীরাকানি ফোর্ট থেকে বেরিয়ে খাড়াই পথেই ফিরে গেলেন ছেলের কাছে৷ খবর পেয়ে মহারাজা হীরাকানিকে সাহসীকতার পুরষ্কার দিয়েছিলেন। আর ওনার নামে একটি প্রাচীর তুলে দিয়েছিলেন যা আজও আছে৷ বলেছিলেন একটি মা যদি বিপদ মাথায় নেমে যেতে পারে তাহলে যে কেউ পারবে৷
ফোর্টের নগরখানা দরওয়াজার সামনে দুটি হাতি দাঁড়িয়ে থাকত আভিজাত্যপূর্ণ স্বাগতম জানাতে। এক ইংরেজ প্রশ্ন করেছিলেন হাতি এতো উঁচুতে এলো কিভাবে। উত্তর দেননি৷ তবে নানান ইতিহাস থেকে জানা যায় এই ইচ্ছে তাঁর ফোর্ট অলংকৃত করার শুরু থেকেই ছিল। তাই সেই সময় দুটো বাচ্চা হাতি নিয়ে আনা হয়েছিল এবং বড় হয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে ফোর্টের আন বান শান বাড়িয়ে তুলেছিল৷
এইটুকুই সব না। রায়গড় ফোর্টে প্রায় তিনশ ঘর আর দু'হাজার সৈনিকের থাকার জায়গা ছিল। এছাড়াও ট্যাঁকশাল, কোষাগার, বেশ কিছু ছোট বড় জলাশয় ছিল। এই ফোর্ট পুরোটা দেখতে দু ঘন্টা নয় দুদিনও কম পড়ে যায়৷ ফোর্টের ভেতর টুরিস্টদের থাকার জায়গা নেই। আর আমাদেরও নিত্য ব্যস্ততার তাগিদে ফেরার তাড়াই বড় হয়ে ঠেকল খানিক পর। তাই ফোর্ট আর শিবাজী মহারাজ থাকল নিজের জায়গায় আর আমরাও ফিরে এলাম যে যার আস্তানায়।
পোস্টের ধরণ | ট্রাভেলগ |
---|---|
ছবিওয়ালা | নীলম সামন্ত |
মাধ্যম | স্যামসাং এফ৫৪ |
লোকেশন | রায়গড় ,মহারাষ্ট্র(https://what3words.com/broadcasting.monstrously.apologetics) |
১০% বেনেফিশিয়ারি লাজুকখ্যাঁককে
~লেখক পরিচিতি~
আমি নীলম সামন্ত। বেশ কিছু বছর কবিতা যাপনের পর মুক্তগদ্য, মুক্তপদ্য, পত্রসাহিত্য ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করেছি৷ বর্তমানে 'কবিতার আলো' নামক ট্যাবলয়েডের ব্লগজিন ও প্রিন্টেড উভয় জায়গাতেই সহসম্পাদনার কাজে নিজের শাখা-প্রশাখা মেলে ধরেছি। কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধেরও কাজ করছি। পশ্চিমবঙ্গের নানান লিটিল ম্যাগাজিনে লিখে কবিতা জীবন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি৷ ভারতবর্ষের পুনে-তে থাকি৷ যেখানে বাংলার কোন ছোঁয়াই নেই৷ তাও মনে প্রাণে বাংলাকে ধরে আনন্দেই বাঁচি৷ আমার প্রকাশিত একক কাব্যগ্রন্থ হল মোমবাতির কার্ণিশ ও ইক্যুয়াল টু অ্যাপল আর প্রকাশিতব্য গদ্য সিরিজ জোনাক সভ্যতা।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
আমার বাংলা ব্লগ পরিবারের সব্বাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন৷ ভালো থাকুন বন্ধুরা। সৃষ্টিতে থাকুন।
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
https://x.com/neelamsama92551/status/1870878882615980517?t=u8gqBpOVsZQonZZUZHP7Dg&s=19