দাঁড়পাল্লার দুই দিকে— কোয়ালিটি ও কোয়ান্টিটি || জেনারেল রাইটিং
প্রিয় আমার বাংলা ব্লগের বন্ধুরা,
সমস্ত ভারতবাসী এবং বাংলাদেশের বাঙালি সহযাত্রীদের আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
আশা করি আপনারা ঈশ্বরের কৃপায় সুস্থ আছেন, সব দিক থেকে ভালোও আছেন। আপনাদের সবার ভালো থাকা কামনা করে শুরু করছি আজকের ব্লগ।
প্রতি সপ্তাহেই আমি একটা করে জেনারেল রাইটিং লিখি যেখানে নানান বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করি। আগের সপ্তাহে গদ্যকে কিভাবে সুখ পাঠ্য করা যায় তা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছিলাম, তবে তার দ্বিতীয় পর্বটি এই সপ্তাহে আর লিখলাম না, কিছুদিন পরেই নিশ্চয়ই লিখব। আজ টাইটেল এবং ছবিটি দেখে বুঝতেই পারছেন আমি লিখতে চাইছি কোয়ালিটি ও কোয়ান্টিটি নিয়ে। কোয়ালিটি অর্থাৎ কোন উৎপাদনের গুণ আর কোয়ান্টিটি অর্থাৎ উৎপাদনের পরিমাণ।
প্রত্যেকটি মেশিনের যেমন নির্দিষ্ট ক্ষমতা থাকে তেমনি মানুষের ও নির্দিষ্ট ক্ষমতা থাকে। শুধু মানুষের কেন পশু পাখি সবারই নির্দিষ্টই ক্ষমতা থাকে। পার্থিব জগৎ অসীম ক্ষমতা সম্পন্ন নয়৷ ফলে আমরা প্রত্যেকেই যখন নির্দিষ্ট সময়ে কোন কিছু উৎপাদন করি তা সে রান্নাই হোক কবিতাই হোক বা হাতে তৈরি করা কোন জিনিস বা অন্য কিছু, তার নিশ্চিত ভাবে গুণগতমান থাকে। হতে পারে সেটা মাঝারি মানের বা নিম্নমানের বা অত্যন্ত উচ্চমানের। কিন্তু যখন চাহিদা বেশি থাকে ওই নির্দিষ্ট সময়েই উৎপাদনের মাত্রা বাড়াতে হয় ফলে তার মান কোনভাবেই বজায় থাকে না।
উদাহরণস্বরূপ বলি, একটা সময় ছিল যখন আমরা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা পুকুরের মাছ খেতাম, মুরগি খেতাম। আমার বেশ মনে আছে। ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে মুরগির মাংস রান্না হতো বছরে তিন থেকে চার দিন। এটা যে টাকার অভাবে হতো তা নয় এতোখানি খাবার চাহিদা ছিল না। তখন বেশিরভাগ মানুষের বাড়িতেই এমন রান্নাবান্না হত। কিন্তু বর্তমানে লোকসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে জীবন যাপন বদলের সাথে সাথে আমরা সপ্তাহে হয়তো তিন চার দিন মুরগি খাই। অর্থাৎ বাজারে চাহিদা বেড়েছে। সেই চাহিদা তো আর স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা মুরগি মেটাতে পারবেনা তাই কম সময়ে অধিক উৎপাদন করা যায় এমন পদ্ধতিতে মুরগি বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। আমার গ্রামের বাড়িতে সেরকমই অনেক ফার্ম রয়েছে যেখানে প্রতি চল্লিশ দিনে এক একটি মুরগির ওজন প্রায় তিন কেজি হয়ে যায়। যেহেতু ফার্মের মুরগি, তাই ওদের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা অনেক কম। ভাইরাস লেগে তাড়াতাড়ি মরে যায় অনেক সময় তখন ব্যবসায় ক্ষতি। এই ক্ষতি লাঘব করার জন্য একটি ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলো যা ভাইরাস লাগার সাথে সাথে পরিণত মুরগিকে দিলে মুরগিটি আগামী চার থেকে পাঁচ দিন ভাইরাস নিয়েই বেঁচে থাকবে। ওই চার পাঁচ দিনের মধ্যে সমস্ত মুরগি মার্কেটে চলে যাবে এবং বিক্রি হয়ে যাবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে চাহিদা মেটানোর জন্য কোয়ানটিটি আমাদের বজায় রাখতেই হয়। কিন্তু কোয়ালিটি কি, সত্যিই বজায় থাকে? শুধু মুরগির ক্ষেত্রে হয় তা নয়, বর্তমানে মাছ শাক সবজি ছাগল ইত্যাদি সবকিছুতেই এই প্রয়োগ দেখা যায়।
তাহলে কোয়ালিটি আর কোয়ান্টিটি কিন্তু একই ভাবে বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
এমনকি লেখালেখির ক্ষেত্রেও আমরা লক্ষ্য করেছি, যখন দিনে একটা কবিতা লিখছি বা দুদিনে একটা কবিতা লিখছি সেই কবিতার কোয়ালিটি আর দিনে পাঁচটা লিখলে তার কোয়ালিটির মধ্যে অনেক তফাৎ হয়ে যায়। একেক সময় লেখাগুলো মনোটোনাশ হয়। হঠাৎ একই লাইন ঘুরেফিরে লিখছি বা একই শব্দের প্রয়োগ করে যাচ্ছি। এভাবে নিজের বুদ্ধিমত্তা এবং ক্ষমতা কে কখনোই ধারালো করা যায় না। তাই আমার মনে হয় যেখানে কোয়ান্টিটি বিচার্য হয়ে দাঁড়ায় সেখানে কোয়ালিটির কোন স্থান নেই। কোয়ালিটি বজায় রেখে অধিক পরিমাণে উৎপাদন কখনোই শিল্প স্রষ্টার ক্ষেত্রে দেখা যায় না।
একটি প্রাবন্ধিক যেকোনো বিষয়ে প্রবন্ধ লিখতে কম করে একমাস সময় নেন। কারণ তাকে পড়াশোনা করতে হয়, তথ্য জোগাড় করতে হয়, এবং নানান দিক বিচার করতে হয়। যা কিছু আগে লেখা হয়ে গেছে সেগুলোই হুবহু তুলে দিলে সেখানে নতুনত্ব কিছু থাকে না। তবে নতুন প্রাবন্ধিকের প্রবন্ধ পড়বই বা কেন?
আমরা যারা প্রতিনিয়ত লিখি, বা আঁকি বা কোন জিনিস তৈরি করি সবকিছুতেই নতুনত্ব বা অভিনবত্ব আনতে গেলে সময় দরকার হয়। নতুন ভাবনা মাথায় আসতে যেমন সময় লাগে তাকে বাস্তবায়িত করতেও সময় লাগে। সেক্ষেত্রে যারা ভাবে আমি প্রত্যেকদিন যা লিখছি বা যা রান্না করছি সবটাই উচ্চমানের তা মুর্খামি ছাড়া অন্য কিছুই নয়। নিজের বিচারে নিজেকে দারুন বলা বা সুন্দর বলা কেবলমাত্র মূর্খরাই পারে।
বিখ্যাত ছড়াকার হরিশচন্দ্র মিত্রের কয়েকটি লাইন মনে পড়ল,
আপনারে বড় বলে, বড় সেই নয়
লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়।
বড় হওয়া সংসারেতে কঠিন ব্যাপার
সংসারে সে বড় হয়, বড় গুণ যার।
গুণেতে হইলে বড়, বড় বলে সবে
বড় যদি হতে চাও, ছোট হও তবে।
এই জন্যই বোধহয় বাজারে কোয়ালিটি চেকিং এর ডিপার্টমেন্ট আলাদা রয়েছে। যেকোনো দ্রব্যমূল্যের কোয়ালিটি দেখার জন্য তারা নানান পরীক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন।
বাজারে আজকাল বেশ কিছু অর্গানিক জিনিস পাওয়া যায় যা পরিমাণে কম থাকে কিন্তু মূল্য অনেক বেশি হয়। ঘরোয়া চাষের শসা থেকে শুরু করে ফুলকপি বাঁধাকপি ও আসে, পরিমাণ খুব কম থাকে। যারা ঘরোয়া জিনিস খেতে পছন্দ করে তারা সাত তাড়াতাড়ি এসে কিনে নিয়ে চলে যায়। এবং দাম দিয়েই কেনে।
এই জিনিস দেখে বুঝি কোয়ান্টিটি জিনিসের দামের থেকে কোয়ালিটির দাম অনেক বেশি। কিন্তু যেখানে কোয়ালিটির মূল্যায়ন না হয়ে কোয়ান্টিটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায় সেই জায়গার মান কি ঊর্ধ্বমুখী?
আমির খানের সিনেমাগুলোর কথা ভাবছি, বছরে একটা কিন্তু সারা বছরের দেখা সেরা সিনেমার একটা হয়েই থেকে যায়। তাই ভাবি, পরিমাণের গড্ডলিকা প্রবাহে না ভিড়ে গিয়ে গুনসম্পন্ন প্রবাহে কচ্ছপ গতিই শ্রেয়। তাতে উন্নতি অবশ্যম্ভাবী।
অনেক বকবক করলাম আজ, এইসব কথার সাথে সহমত হবার লোক হয়তো নেই বা পড়ারও লোক কম। তাও সংসারে স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী খাবার সব সময়ের জন্য উচ্ছে আর নিমপাতাই উপকারী। অর্থাৎ বিটার ট্রুথ — তেতো অথচ সত্যি।
পোস্টের ধরণ | জেনারেল রাইটিং |
---|---|
লেখিকা | নীলম সামন্ত |
মাধ্যম | স্যামসাং এফ৫৪ |
লোকেশন | পুণে,মহারাষ্ট্র |
১০% বেনেফিশিয়ারি লাজুকখ্যাঁককে
~লেখক পরিচিতি~
আমি নীলম সামন্ত। বেশ কিছু বছর কবিতা যাপনের পর মুক্তগদ্য, মুক্তপদ্য, পত্রসাহিত্য ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করেছি৷ বর্তমানে 'কবিতার আলো' নামক ট্যাবলয়েডের ব্লগজিন ও প্রিন্টেড উভয় জায়গাতেই সহসম্পাদনার কাজে নিজের শাখা-প্রশাখা মেলে ধরেছি। কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধেরও কাজ করছি। পশ্চিমবঙ্গের নানান লিটিল ম্যাগাজিনে লিখে কবিতা জীবন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি৷ ভারতবর্ষের পুনে-তে থাকি৷ যেখানে বাংলার কোন ছোঁয়াই নেই৷ তাও মনে প্রাণে বাংলাকে ধরে আনন্দেই বাঁচি৷ আমার প্রকাশিত একক কাব্যগ্রন্থ হল মোমবাতির কার্ণিশ ও ইক্যুয়াল টু অ্যাপল আর প্রকাশিতব্য গদ্য সিরিজ জোনাক সভ্যতা।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
আমার বাংলা ব্লগ পরিবারের সব্বাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন৷ ভালো থাকুন বন্ধুরা। সৃষ্টিতে থাকুন।
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
বাহ্ দিদি চমৎকার বিষয় নিয়ে আজকে জেনারেল রাইটিং পোস্ট শেয়ার করেছেন পরে অনেক ভালো লাগলো। সত্যি বলতে আপনার এই পোস্টটা অনেক শিক্ষনীয়। কোয়ালিটি আর কোয়ান্টিটি দুইটা আলাদা জিনিস। সবার উচিত কোয়ান্টিটিটি থেকে কোয়ালিটির গুরুত্ব টা বেশি দেওয়া। তাহলে সবার থেকে ভালো কিছু আশা করা যাবে। অনেক সুন্দর একটি পোস্ট আমাদের মাঝে বিস্তারিতভাবে শেয়ার করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিদি।
বেশ লিখেছেন আপু। আসলে কোন কিছুই অতিরিক্ত ভালো না। আমরা যদি মানসম্পন্ন কিছু পেতে চাই তবে সময় লাগবেই। আল্প সময় বেশি পরিমাণে কোন কিছু পাওয়া গেলে তার মান পরে যাবেই। আর সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে তা আরও বেশি গুরুত্বপুর্ণ। তার জন্য চিন্তার সময় দরকার। তবেই কোয়ালিটি সম্পন্ন কিছু আসবে।
যেকোনো কাজের ক্ষেত্রে সত্যি বলতে কোয়ালিটি এবং কোয়নটিটি একসঙ্গে বৃদ্ধি করা সম্ভব না। ঐ দাঁড়িপাল্লার মতো। নির্দিষ্ট একটা জায়গা পযর্ন্ত দুইটাই ঠিক থাকে। কিন্তু এর পরে আর যেকোনো একটা বৃদ্ধি করতে গেলে স্বভাবত ভাবেই আরেকটা কমে যায়। দারুণ লিখেছেন আপু।
খুব সুন্দর একটি বিষয় তুলে ধরেছেন। খারাপ জিনিসের কোয়ান্টিটি বেশি হলেও তার কোন মূল্য নেই। কিন্তু কোয়ালিটি পূর্ণ ভালো জিনিস অল্প হলেও তার অনেক মূল্য আছে। সেটা আমরা বাস্তবে দেখতে পাই। তাই কোয়ান্টিটি না দেখে কোয়ালিটির দিকে নজর দিতে হবে। ধন্যবাদ।