ছোটগল্প "রক্তঝরা অভিশপ্ত রাত" - ০৪

in আমার বাংলা ব্লগ3 years ago

[ঐতিহাসিক সত্য ঘটনা অবলম্বনে নিচের গল্পটি রচনা করা হয়েছে । এর আগে একাধিক খ্যাতিমান লেখক এই রক্তজল করা সত্য ঘটনা অবলম্বন করে অনেক গুলি গল্প রচনা করে গিয়েছেন । তন্মধ্যে "সিংহ কবলিত যাত্রী ট্রেন", লেখক বীরু চট্টোপাধ্যায়, গল্পটির কিছু কিছু অংশ এখনো মনে আছে । খুব ছোটবেলায় শিশুসাথীর পূজাবার্ষিকীতে গল্পটি পড়েছিলুম।
তবে, আমার আজকের লেখাটি একেবারেই সত্য ঘটনা অবলম্বনে মৌলিক লেখা ]



কপিরাইট ফ্রী ইমেজ সোর্স : Pixabay


তৃতীয় পর্বের পর ...


ধ্য রাত্রির প্রথম ভাগে শুরু হলো আক্রমণ । এ যেন সিংহদের একটি সুপরিকল্পিত অভিযান । আক্রমণের সূচনাতেই একদল সিংহ অগ্নিসীমার খুব কাছে এসে পড়লো ।

আগুনের বেড়া টপকানোর ফাঁক খুঁজছে তারা । অগ্নিকুন্ডের কাছে প্রহরারত শিকারিদের সাথে তাদের যুদ্ধ বেঁধে গেলো । গুলির পর গুলি চললো । আঁধারে কম্পিত অগ্নিশিখার বিভ্রান্তিকর স্বল্প আলোকে শিকারীরা সঠিক নিশানায় গুলি ছুঁড়তে ব্যর্থ হলো । তার ওপর সিংহেরা খুব দ্রুত পায়চারি করছে, নিশানা ঠিক রাখাই কষ্টকর খুব ।

এর মধ্যে একটি দু'টি সিংহ গুলিবিদ্ধ হয়ে বিশাল গর্জনে চারিদিক প্রকম্পিত করে তুললো । ক্ষুধার্ত সিংহ ভয়াবহ ঠিকই, কিন্তু আহত সিংহ মৃত্যুরই নামান্তর । সাক্ষাৎ মৃত্যদূত । এর মধ্যে আহত একটা সিংহ মরিয়া হয়ে আগুনের বেড়া টপকে লাফ দিয়ে এক শিকারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো । একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে স্নায়ুর ওপর আশ্চর্য দখল দেখিয়ে নির্ভুল নিশানায় অকম্পিত হস্তে রাইফেলের দুটি ব্যারেল খালি করে দিলো সেই শিকারী । মুহূর্তের মধ্যে একটা মরণ আর্তনাদ করে ভবলীলা সাঙ্গ করলো সেটি ।

পুবদিকে যখন প্রহরীদের সাথে সিংহদের এই লড়াই বেঁধেছে সেই সুযোগে পশ্চিমদিকে আরেকদল সিংহ আগুনের বেড়া টপকে ঢুকে পড়লো । এর কারণ প্রহরীদের অন্যমনস্কতা । পুবদিকে গুলি চলা মাত্র সবার নজর আর মনোযোগ সেদিকে ছিল । এক মুহূর্তের এই সুযোগটাই যেন খুঁজছিলো ধূর্ত সিংহেরা । মুহূর্তে বেশ কয়েকটা সিংহ লাফের পর লাফ মেরে বিদ্যুৎ বেগে অগ্নিসীমা পেরিয়ে ট্রেনের গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো ।

অগ্নিকুন্ডের কাছে প্রহরারত শিকারিরা সামনের ভাগে পাহারায় নিযুক্ত ছিল । কোনক্রমেই তারা অগ্নিকুন্ডের দিকে পিছন ফিরে ট্রেনের গায়ে লাফিয়ে পড়া সিংহদের পানে গুলি ছুঁড়তে পারলো না । কারণ তাহলে অগ্নিকুন্ডের বাইরের সিংহদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর । সিংহদের দিকে পিছন ফিরলেই তারা তৎক্ষণাৎ আক্রমণ করে । আবার কামরার ছাদের উপরে প্রহরারত শিকারীরাও ঠিকভাবে নিশানা স্থির করে গুলি করতে ব্যর্থ হলো । কারণ, কামরার দেওয়ালের খুব কাছে অবস্থানরত সিংহদের রাইফেলের নিশানার মধ্যে পাওয়াই এক রকম অসম্ভব ।

তারপরেও গুলি চললো । কামরার ছাদের একেবারে কিনারে এসে রাইফেলের নল নিচু করে যথাসাধ্য নিশানা স্থির করে গুলি চললো । এখনকার সয়ংক্রিয় রাইফেল নয় । তখনকার আমলের বন্দুক রাইফেল প্রায় সবই ছিল গাদা বন্দুক টাইপের । যদিও সপ্তদশ শতকের শেষ ভাগে আর অষ্টাদশ শতকের শুরুতে রাইফেলের ব্যাপক উন্নতিসাধন হয় । আলাদা করে বারুদ গাদার বদলে বুলেটের শেষভাগে বারুদের একটা টোপর পরানো হয়ে থাকে । সৌভাগ্যক্রমে এই শিকারীদল আর গার্ডদের কাছে ছিল আধুনিক রাইফেল । বারুদ গাদার তাই দরকার পড়েনি আর । ফলে যথেষ্ঠ দ্রুত গুলি করা যাচ্ছিলো ।

একটা সিংহ মরলো । দুটো মরলো । তিনটে । চারটে .......

ততক্ষনে প্রায় ১৫-১৬ টা সিংহের একটা দল এসে আক্রমণ করলো ট্রেনের চাকার আড়ালে আত্মগোপন করে থাকা যাত্রীদের । ক্ষিপ্র হস্তে তাদের কয়েকটিকে শমনে পাঠালো শিকারীরা । কিন্তু, শেষরক্ষা আর হলো না । ততক্ষনে অনেকগুলো সিংহ এসে ট্রেনের চাকার নিচে ঢুকে গিয়েছে । কয়েকটি মুহূর্ত মাত্র । সহসা কালরাত্রির বুক চিরে বীভৎস আর্তনাদে চারিদিক ভরে উঠলো ।

চাকার নিচে হত্যালীলায় মেতে উঠেছে সিংহেরা । গার্ডরা গুলি ছুঁড়তে গিয়েও পারলোনা । যাত্রীদের গায়ে লাগার সম্ভাবনা । ততক্ষনে ট্রেনের নিচে নরক ভেঙে পড়েছে । চিৎকার, চেঁচামেচি আর কান্নার শব্দের সাথে সিংহদের রক্তজল করা গর্জনে আকাশ বাতাস ভরে উঠলো । সেই বীভৎস আওয়াজে ট্রেনের কামরার প্রত্যেকটা মানুষ জমে একদম পাথর । চোখের কোল বেয়ে শুধু অশ্রু গড়িয়ে পড়া ছাড়া আর কিই বা করতে পারে তারা !

এবার কিন্তু আক্রমন খুব বেশিক্ষন দীর্ঘ হলো না । একের পর এক যাত্রীদের ঘাড় কামড়ে সিংহেরা আগুনের বেড়া টপকে পাশের গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়লো । গুলি চললো । একের পর এক লুটিয়ে পড়লো বেশ কয়েকটা সিংহ । কিন্তু, অধিকাংশই ততক্ষনে নিরাপদে জঙ্গলে ঢুকে গিয়েছে । রাইফেলের রেঞ্জের বাইরে তারা ।

ক্রমে কাল রাত্রি প্রভাত হলো । গার্ডরা দৌড়ে চাকার তলের যাত্রীদের খোঁজ নিতে এলো । সে এক নারকীয় দৃশ্য সেখানে । ছিন্নভিন্ন বেশ কয়েকজন যাত্রীর মৃতদেহ পড়ে । রক্তের স্রোত বইছে ট্রেনের চাকার তলে । আহত যাত্রীদের দ্রুত বের করে যথাসম্ভব প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া শুরু করলো । আজ প্রভাতের পরও কেউ আর কামরা থেকে বের হলো না । দুপুর গড়িয়ে গেলো তাও কেউ নড়লো না কামরা থেকে । ক্ষুধা তৃষ্ণার বোধটুকুও তাদের যেন চলে গিয়েছে ।

এমন সময়ে রিলিফ ট্রেনটা এসে পড়লো । যতক্ষণ আগের দু'রাত্রির ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনা করছিলেন রেলের চালক আর গার্ডরা ততক্ষনে রিলিফ গাড়ির থেকে ডাক্তার আর নার্সরা ব্যান্ডেজ আর ওষুধপত্র নিয়ে এসে আহতদের সুচিকৎসা শুরু করে দিয়েছেন । রিলিফ ট্রেন থেকে স্বেচ্ছাসেবকের একটা দল এসে যাত্রীদের সবাইকে আহার্য ও পানীয় দিলো । রেলের ইঞ্জিনিয়ার আর মজুরেরা এসে ইঞ্জিন সারাইয়ের কাজ শুরু করে দিলো ।

এবার মৃতদেহের সৎকারের পালা । সেনার একটি দল চাকার নিচ থেকে আর ট্রেনের কামরার আশপাশ থেকে ছিন্নভিন্ন বেশ কয়েকটি মৃতদেহ এক জায়গায় জড়ো করে রেখে জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করলো । কিছু দূর যেতেই চোখে পড়লো ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নিহত মানুষেদের ভুক্তাবশিষ্ট, হাড় গোড়, মাথা । সিংহ কোনো প্রাণীর মাথা খায় না, মানুষেরও না । কিন্তু, দেখা গেলো অধিকাংশ মাথা ভাঙা, কারা যেন খুব পরিতৃপ্তি নিয়ে চিবিয়েছে সেগুলো । বোঝা গেলো হায়েনার দলের কাজ এটা । সিংহদের খাওয়ার পরে এরা এখানে ভোজসভা করেছে ।

যাই হোক, সে বীভৎস দৃশ্য তাকিয়ে দেখা যায় না । পরনের ছিন্ন পোশাক দেখে ছাড়া কাউকেই সনাক্ত করা সম্ভবপর হলো না । দু'দিন আগের সিংহের প্রথম শিকার সেই হতভাগ্য বালকের ছিন্ন ভিন্ন রক্তমাখা হাফ প্যান্ট দেখে তাকে সনাক্ত করা গেলো । হৃদয়বিদারক সে সব দৃশ্য ।

সমস্ত শবদেহের অবশিষ্টাংশ এক জায়গায় জড়ো করে কবর দেওয়া হলো । গান ফায়ার করে স্যালুট জানানো হলো বিদেহীদের প্রতি । সন্ধ্যের সামান্য পূর্বে ইঞ্জিন মেরামত করে রেলওয়ে ক্রেনের সাহায্যে ইঞ্জিন লাইনের ওপর তুলে যাত্রা শুরু করলো অবশেষে । এক গাড়ি যাত্রীদের মধ্যে ২৩ জন যাত্রী পড়ে রইলো গভীর জঙ্গলের এই নির্জন প্রান্তরে, মাটির নিচে শায়িত হয়ে । গন্তব্যে পৌঁছনো তাদের আর হলো না ।

[শেষ]

Sort:  
 3 years ago 

দাদা পূর্ব দিকে যখন প্রহরীরা সিংহর আক্রমণ ঠেকানোর জন্য ব্যস্ত ছিল। তখন পশ্চিম দিক থেকে প্রহরীদের অসতর্কতাবশত সিংহরা প্রবেশ করে। এবং সিংহরা সেখানে হত্যাযজ্ঞ চালাতে লাগে খুবই ভয়াবহ একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। দাদা সিংহের আক্রমণে শিশুর হাফপ্যান্ট দেখে তাকে সনাক্ত করা হলো এই বিষয়টি আমাকে ভীষণভাবে মর্মাহত করেছে। গল্পটি পড়ে গায়ের পশম দারিয়ে যাওয়ার মত হয়েছে।

Hi @rme,
my name is @ilnegro and I voted your post using steem-fanbase.com.

Come and visit Italy Community

 3 years ago 

শেষমেশ শেষ পর্বটা পেলাম।আমি ভেবেছিলাম এটাও প্রায় ভুলে যাবেন দাদা।ভয়ংকর কাহিনী ছিলো ট্রেনের নিচের ঘটা কাহিনীটা।গা হিম করে দেওয়া লেখা।আশ্চর্য না হয়ে পারলাম না।দাদা আরো গল্প চাই কিন্তু।

 3 years ago 

দাদা ট্রেনের নিচে চাকা পাশে লুকিয়ে থাকা সেই লোকগুলোর বীভৎস আর্তচিৎকারে প্রতিধ্বনি এখনো যেন আমি শুনতে পাচ্ছি। আমি জানিনা আপনার লিখতে কি রকম অনুভূতি হয়েছিল। কিন্তু পড়তে পড়তে আমার চোখের কোনে পানি চলে এসেছিল। ট্রেনের নিচে লুকিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত যদি তারা না নি তো তাহলে হয়তো এতগুলো প্রাণ গভীর জঙ্গলে মাটিচাপা পড়ে থাকত না। ছিন্নভিন্ন প্যান্টের অংশ পেয়ে সেই মায়ের কি অবস্থা হয়েছে ভাবতেও খুব খারাপ লাগছে। দাদা এত বড় একটা বীভৎস চাঞ্চল্যকর ঘটনা এতদিন আমাদের অজানাই থেকে গিয়েছিলো। আপনার এই লেখাগুলোর মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম। ঘটনাটি আমাদের সামনে নিয়ে আসার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

Greetings friend! I hope you are very well, I wanted to ask you if you could support the Starsofsteem community with a delegation! We will configure the respective vote in favor although it is not yet much! It would be very helpful, maybe this will boost the activity within the community a little more!

 3 years ago 

দাদা কি বলবো ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। যারা বেঁচে ছিলো,তারা মৃত্যু কত কাছ থেকে দেখেছে।গল্পটা যত ফিল করছি ততই ভয় লাগছে।মনে হচ্ছে চোখের সামনে, সিংহ আর রক্তের মাখামাখি। গল্পটা পড়ে বেশ ভালো লেগেছে, কষ্ট ও লেগেছে। ধন্যবাদ

 3 years ago 

গল্পটা খুব সহজেই পড়ে ফেললাম কিন্তু অনুভব করতে গেলে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। অরক্ষিত অবস্থায় সিংহের আক্রমণের মুখে মানুষ। রাতের অন্ধকারে ঝাকে ঝাকে সিংহের আক্রমণের শিকার হয়ে মারা যাচ্ছে মানুষ। সত্যিই ভয়ংকর আর মারাত্মক হৃদয়বিদারক এক দৃশ্য। সে সময় কেমন ছিল আফ্রিকার পরিবেশ তার অনেকটাই ফুটে উঠেছে আপনার গল্পে। ধন্যবাদ দাদা

 3 years ago 

সত্যি দাদা সেদিন রাতে হৃদয় বিদারক একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল। আর আপনি আপনার চমৎকার লেখনীর মাধ্যমে দারুন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সেই কাহিনীটি। যেন চোখের সামনে পুরো ঘটনাটি আমি দেখতে পেলাম। সত্যিই অসাধারণ আপনার লেখা ।ধন্যবাদ আপনাকে আমাদের সঙ্গে শেয়ার করার জন্য ।

আর পরবর্তীতে অবশ্যই ভূতের গল্প চাই কিন্তু।

এতো জলদি শেষ হয়ে গেল গল্পটা। মনে হয় এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম । চমৎকার লিখেছেন দাদা । এখনো ট্রেনের যাত্রীদের পরিণতির কথা চিন্তা করে রক্ত হিম হয়ে আসছে ।