Book Review: "দারবিশ", লতিফুল ইসলাম শিবলী
গত কয়েকদিন ধরে একটি বই পড়ছিলাম। বইটির নাম দারবিশ, এর ইংরেজি প্রতিশব্দ Saint. লিখেছেন লতিফুল ইসলাম শিবলী।
লেখক পরিচিতি |
---|
লতিফুল ইসলাম শিবলী বর্তমান প্রজন্মের কাছে খুবই পরিচিত নাম। আমার তাঁর সম্পর্কে জানার আগ্রহ জাগে তাঁর বই আসমান পড়ে (আসমান'র গল্প অন্য একদিন বলবো)। তিনি ২০১৭ সালের একুশে বইমেলায় কথাসাহিত্যিক বা ঔপন্যাসিক হিসেবে নতুন পরিচয়ে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি আমাদের সকলের প্রিয় ব্যান্ড সংগীত, আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি, হাসতে দেখো গাইতে দেখো, কেউ সুখি নয়, প্রিয় আকাশী'র মতো প্রায় চারশত জনপ্রিয় গানের রচয়িতা। বাংলাদেশে ব্যান্ড সংগীত আন্দোলন নামে ব্যান্ড সংগীতের ওপর লিখিত প্রথম এবং একমাত্র গবেষণাধর্মী প্রবন্ধগ্রন্থ লিখেছেন তিনি, যেটি ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়।
তার বিখ্যাত বইগুলোর মধ্যে দারবিশ(প্রথম বেস্টসেলার,২০১৭), দ্বিতীয় বেস্টসেলার দখল(২০১৮), তৃতীয় বেস্টসেলার আসমান(২০১৯), রাখাল (২০২০) এবং ফ্রন্টলাইন অন্যতম। এবং দারবিশ তাঁর প্রথম উপন্যাস।
লতিফুল ইসলাম শিবলী'র বই ভালো লাগার কারণ |
---|
তাঁর বই ভালো লাগার অন্যতম কারণ হলো তাঁর বইয়ের চরিত্রগুলো। চরিত্রগুলো এতোটাই আকর্ষনীয় থাকে, যে কেউ নির্দ্বিধায় এর মধ্যে ঢুকে যেতে পারে, চরত্রগুলোকে নিজের মধ্যে ধারন করতে পারে। সেটা পাঠকের ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় দুইভাবেই হতে পারে। তাঁর বইয়ের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি তার মেক্সিমাম বইয়ের ভালোবাসা-ধর্ম, যুদ্ধ-ভালোবাসা, এবং বন্ধুত্ব-রাষ্ট্রের মধ্যে সমন্বয় করার চেষ্টা করেছেন। আমি মনে করি তিনি এসবের সমন্বয়টা খুব সফলভাবেই করেছেন।
তার বইয়ের সমাপ্তি তিনি খুব যত্নসহকারে করেন, যাতে খুব সহজেই পাঠকের সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব। জন্যই মূলত তার বই ভালো লাগে।
বইটির মূল চরিত্র |
---|
১. জামশেদ, মেলিনি এবং
২. সঞ্জু, রোদেলা
আরো অনেকগুলো চরিত্র আছে বইটিতে। কিন্তু এই চারটা চরিত্র রপ্ত করতে পারলেই আপনার এই বইটি পড়া স্বার্থক হবে। এদের একজনকেও মিস করলে আপনি ব্যর্থ।
বইটির মূলভাব |
---|
জামশেদ, মেডিক্যালে পড়ুয়া বাংলাদেশী এক বালক। মেডিক্যালে ফোর্থ ইয়ারে পড়াকলীন তার প্রেমিকা আফরোজার বিয়ে হয়ে যায়। অথচ ছোটবেলা থেকে তাদের একসাথে বেড়ে ওঠা এমনকি আফরোজা তাকে ডাক্তার হিসেবে দেখতে চাইতো বলেই জামশেদ ইঞ্জিনিয়ারিংএ একবছর ড্রপ দিয়ে মেডিক্যালে এডমিশন নেয়।
আফরোজার বিয়ে হয়ে গেলে একরকম অভিমান থেকেই সে আমেরিকায় পাড়ি জমায় ডাক্তারি পড়ার উদ্দ্যেশ্যে। সেখানে সে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় মেডিক্যাল ফ্যাকাল্টিতে ভর্তি হয়। জামশেদ যখন আমেরিকায় যায় আমেরিকা তখন ভিয়েতনাম যুদ্ধে টালমাটাল। একদল আমেরিকান ভিয়েতনাম গিয়ে যুদ্ধ করছে। আরেক দল তরুন আমেরিকায় ভিয়েতনাম যুদ্ধ বন্ধের দাবীতে যুদ্ধ-বিরোধী আন্দোলন করছে। এই তরুনদের দাবী আমেরিকা অন্যায় যুদ্ধে লীপ্ত হয়েছে। ভিয়েতনামের সাথে অন্যায়ভাবে যে যুদ্ধ চলছে সেটি বন্ধের জন্য তারা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। তখনকার আমেরিকান তরুন্যের জিবন মানেই সেক্স ড্রাগস অ্যান্ড রক এন রোল। এর মানে হচ্ছে, প্রথার বিরুদ্ধে প্রথা, নিয়মের বিরুদ্ধে নিয়ম, সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সংস্কৃতি। এককথায় এটাকে বলা হতো এন্টি কালচার। আরো সহজ করে বলতে গেলে, ছোট চুল রাখা যদি ভদ্রতা আর রীতি হয় তা হলে চুলকে বড় করো, এই নীতি ধারণ করতো তরুনরা। আর সানফ্রানসিসকো শহরকে বলা হতো এই এন্টি কালচার বা হিপ্পি আন্দোলনের রাজধানী। সেখানে সহপাঠীদের সাথে জামশেদ এই আন্দোলনে অংশগ্রহন করে। তখন সে বুঝতে পারে পুঁজিবাদের গভীর সংকট এবং রক্তাক্ত ক্ষতগুলো, এবং এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবনা তাকে পরিনত করেছিলো এক বিশ্বনাগরিকে। সে হিপ্পদের সাথে আমেরিকার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে, যখন আমেরিকার ঘরে যুদ্ধ, বাইরে যুদ্ধ, ঠিক তখন তার জিবনে প্রেম হয়ে আসে "মেলিনি"। মেলিনি প্রখর রাজনীতি সচেতন দেশপ্রেমিক এক আমেরিকান নারী। যে ভিয়েতনাম বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা। এবং তাকে রাশান স্পাই মনে করে হন্যে হয়ে খূ্জছে এফবিআই।
বিশ বছরের যুদ্ধে প্রায় আটান্ন হাজার আমেরিকান সৈন্য নিহত হয়েছিল। আর আহত হয়েছিল লক্ষ লক্ষ। ব্যাটেল গ্রাউন্ডে সৈন্যের চাহিদা পূরণের জন্য সরকার ড্রাফট সিস্টেম চালু করে। এই সিস্টেমের মাধ্যমে সরকার গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টদেরকে যুদ্ধে যেতে বাধ্য করে। আর যারা যুদ্ধে যেতে চাইতো না তাদের নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু হত। এক সময় মেলিনির নামে ড্রাফট আসে। কিন্তু মেলিনি এর প্রতিবাদ সরূপ এক বিশাল জনসভায় ড্রাফট টি পুড়িয়ে দেয় এবং তার পর থেকে শুরু হয় তাদের পলাতক জিবন। তারপর তারা সিদ্ধান্ত নেয় মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে জামশেদ এবং মেলিনি পালিয়ে যাবে। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে যখন তারা চোরাই পথে বর্ডার ক্রস করতে যায় তখন মেলিনি বর্ডার ক্রস করতে পারলেও জামশেদ বর্ডারে আটকা পরে, এবং আটকা পরার আগমুহূর্তে মেলিনি জামশেদকে জানায় তার জঠরে জামশেদের সন্তান। জামশেদ ধরা পরে এবং তার সাত বছরের জেল হয়। মাঝখানে ঘটে যায় আরো অনেক কিছু যেগুলো আপনার হৃদয় ছুঁয়ে যাবে।
প্রায় ৭০ বছর বয়সে সেই তরুন ঢাকায় ফিরে আসে। ঢাকা তার কাছে সিটি অব মিউজিক। এখানে এসে পরিচয় হয় রোদেলা সাথে। রোদেলার সাথে সঞ্জু এবং জামশেদের এক ত্রিমুখী সম্পর্ক বিরাজমান যেটি বুঝতে হলে অবশ্যই আপনাকে বইটি পড়তে হবে।
বইটি থেকে ভালোলাগা কিছু কথা |
---|
১. আমার এক স্কয়ার মিটারের মধ্যে যা আছে এর বাইরে কোনোকিছুই আমার না। তোমার জমিন সেইটুকু যেটুকুর মধ্যে তুমি দাঁড়িয়ে বা বসে আছ। তোমার টাকা সেইটুকু যেটুকু এখন তোমার পকেটে আছে। যদিও ব্যাংকে তোমার হাজার কোটি টাকা আছে। তোমার খাদ্য সেইটুকু যেটুকু তোমার পেটে চলে গিয়েছে। তোমার পোষাক সেইটুকু, যা তুমি এই মুহূর্তে পরে আছ। অনেক কিছুর মালিকান আসলে সেন্স অব ওনারশিপ।
২. সুর যখন ক্ষমতায় সাম্রাজ্য তখন নির্জনতার।
৩. মানুষকে ক্ষমা করতে না পারলে মৃত্যুর পূর্বেই এই পৃথিবীটা তার জন্য নরক হয়ে উঠবে। সুখী হতে হলে ক্ষমা করো আর ভুলে যাও।
মানুষ কারো কাছ থেকে কষ্ট পেলে সে যদি তাকে সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা করে দেয় তাহলে সে একটা কষ্ট পেল। কিন্তু সে যদি ক্ষমা না করে, প্রতিশোধের প্লান করতে থাকে তা হলে এই প্রতিশোধপরায়ণতা তার আর একটি কষ্ট বাড়িয়ে দিল। যতদিন সে প্রতিশোধ না নিতে পারবে ততদিন সে জ্বলতে থাকবে।
৪. বন্দুক দিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করা সহজ কাজ, কিন্তু আদর্শ দিয়ে মানুষের চিন্তাকে পালটে দেয়া অনেক কঠিন কাজ।
৫. দেশ দখলের চেয়ে হৃদয় দখল করা অনেক কঠিন।
৬. যদি স্রষ্টাকে ভালোবাস তবে তার সমগ্র সৃষ্টি জগতকে ভালোবাসবে। এই মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু একে অন্যকে টানে, এই টানেরই এক নাম মায়া, অন্য নাম ভালোবাসা।
৭. ভালোবাসা আর বিশ্বাসহীন জীবন মাঝিহীন নৌকার মতো। তাই ভালোবাসবে আর বিশ্বাস দিয়েই জীবনকে যাপন করবে।
উপন্যাসটির স্থান, কাল এবং ইতিহাস সত্য। কাল্পনিক শুধু এর চরিত্রগুলো। এই বইটির সুন্দর একটি সমাপ্তি বইটিকে আরো শতগুণ অলংকারে অলংকৃত করেছে।
বইটি সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য |
---|
বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারীতে। আমার কাছে যে কপিটি আছে সেটি পঞ্চম মুদ্রণ, প্রকাশিত হয় ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে।
মুদ্রণ : শামীম প্রিন্টিং প্রেস।
মূল্য : ৳৩০০.০০(১২স্টিম)
পার্সোনাল রেটিং : ৮/১০.
আপনি যদি বই পড়তে পছন্দ করেন তাহলে অবশ্যই এই বইটি আপনার জন্য। আশা করি এই বইটি আপনার চিন্তার জগতকে আরো বিস্তৃত করবে। ধন্যবাদ সবাইকে।