টাকা আবিস্কারের ইতিহাস
টাকা ছাড়া জীবন যেন অনেকটাই অচল। তুমি একটা পেন্সিল কিনতে চাও; তোমার একটা আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে অথবা বাইরে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা ভাবছো–যা-ই করতে যাওনা কেন, তার জন্য টাকা দরকার। তো এই টাকা কোথা থেকে এলো, কেমন করে এলো তা নিশ্চয়ই তোমাদের ভাবায়। চলো জানার চেষ্টা করি টাকার জন্মকথা।
প্রাচীন গ্রিক মুদ্রা
টাকা আসলে বিনিময়ের একটা মাধ্যম। তোমার একটা আইসক্রিম দরকার, তুমি আইসক্রিম বিক্রেতাকে এর দাম হিসেবে টাকা দিলে। অন্যদিকে আইসক্রিম বিক্রেতার দরকার বাসার জন্য চাল-ডাল। সে আইসক্রিম বিক্রির টাকার একটি অংশ দিয়ে ওই চাল-ডাল কিনবে।
টাকা একটি মুদ্রার নাম। মুদ্রাই আসলে বিনিময়ের মাধ্যম। একেক দেশের মুদ্রার একেকরকম নাম। যেমন কারো নাম রহিম, কারো করিম। কিন্তু দুজনেরই আসল পরিচয় তারা মানুষ। তেমনই টাকা, ডলার, রূপি, দিনার, ইয়েন, রিঙ্গিত, ইউয়ান, ইউরো-সবই হচ্ছে মুদ্রা।
কিন্তু একটা সময় ছিল যখন টাকা ছিল না। তখনও কিন্তু মানুষের বিভিন্ন জিনিসের প্রয়োজন হতো। তাহলে তখন তারা কিভাবে তাদের ওই চাহিদা মেটাত?
মুদ্রার বিবর্তনের পথে চার ধরনের বিনিময় মাধ্যম
মুদ্রার প্রচলনের আগে যে পদ্ধতিতে মানুষ তার প্রয়োজনের জিনিস সংগ্রহ করতো, তার নাম বিনিময় প্রথা। ধরো, নদী থেকে করিম মাছ ধরেছে, কিন্তু এতো মাছের দরকার নেই। তার দরকার একটু দুধ। তো সে দুধ বিক্রেতাকে মাছ দিয়ে দুধ নিয়ে নিল।
কিন্তু ধরো ওই দুধওয়ালার মাছের দরকার নেই। তাহলে তো করিম মাছ কিনতে পারবে না। অন্যদিকে দুধওয়ালার দরকার একটা তির-ধনুক। কিন্তু তির-ধনুক বিক্রেতার আবার মাছ বা দুধ- এর কোনোটিরই দরকার নেই। তাহলে তো কোনো বিনিময় হবে না। কেউ তার দরকারের জিনিসটা পাবে না।
এমন সমস্যার সমাধান করতে মানুষ একটা উপায় খুঁজে বের করল। বিনিময়ের একটি মাধ্যম ঠিক করলো তারা, আর তার একটি মানও বেঁধে দেওয়া হল। সবাই এটা মেনেও নিল। সবাই মেনে না নিলে কিন্তু মুদ্রার কোনো দাম থাকে না। বিনিময়ের ওই মাধ্যম হলো টাকার ‘পূর্বপুরুষ’।
মুদ্রা বা টাকা আবিস্কারের আগে বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের বস্তুকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। প্রাচীন ভারতে কড়িকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ফিজি দ্বীপে টাকার কাজ চলতো তিমি মাছের দাঁত দিয়ে। সামোস দ্বীপে মাদুরকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
পাথরের মুদ্রা
কোথাও গরু, ছাগল, ভেড়া, কোথাও আবার মাছ ব্যবহৃত হত টাকা হিসেবে। প্রাচীনের কোনো কোনো এলাকায় লবণকে টাকা হিসেবে গণ্য করা হতো। নিউ গিনিতে টাকার কাজ চলত কুড়ালে। প্রশান্ত মহাসগরীয় দ্বীপ ইয়াপে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হতো পাথরের চাকতিকে। নাইজেরিয়ায় টাকার মর্যাদা পেয়েছিল হাতে পরার বালা। দেশ ভেদে এমন অনেক বিচিত্র জিনিসে টাকার কাজ চলতো।
কড়ি, মাছের দাঁত, পালক, মাদুর- এসবে লেনদেন আগের চেয়ে একটু সহজ হলো ঠিকই, কিন্তু পুরো স্বাচ্ছন্দ্য এলো না। এর পেছনে ছিল অনেক কারণ। কড়ি, মাছের দাঁত, পালক ইত্যাদি বহন করা সহজ নয়। আবার একেক দেশে একেকরকম রীতিনীতি বলে এক এলাকার মাধ্যম অন্য এলাকায় অচল। এমন অবস্থায় মানুষ নতুন করে ভাবতে শুরু করল। আর সেখান থেকেই তাদের মাথায় এল তামা, রূপা ও সোনার মুদ্রার।
বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে এক সময় কড়ি ব্যবহৃত হতো
তামা, রূপা ও সোনা মূল্যবান ধাতু। এগুলোতে সহজেই ছাপ দেওয়া যায়। আবার রোদ, বৃষ্টি, পানিতে এগুলো নষ্ট হয় না। এগুলো বহন করাও সহজ। সংরক্ষণ করাও কঠিন নয়। এ কারণে শুরু হল তামার মুদ্রা, রৌপ্য মুদ্রা ও স্বর্ণ মুদ্রার প্রচলন।এক সময় ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবী জুড়ে।
ঠিক কবে, কোন দেশে ধাতব মুদ্রার প্রচলন শুরু হয় তা কিছুটা বিতর্ক আছে। নিশ্চিত করে কেউ করতে পারছে না। তবে জোরালো দুটি মত আছে। এদের এক পক্ষের মতে চীন দেশে প্রথম ধাতব মুদ্রার প্রচলন হয়।
অন্য পক্ষের মতে তুরস্কের লিডিয়া নামের একটি দ্বীপে প্রথম চালু হয় এ মুদ্রা। সেটি যিশু খৃস্টের জন্মের প্রায় এক হাজার বছর আগে।বর্তমানে ২০১৫ সাল চলছে। তার মানে প্রায় ৩ হাজার বছর আগে ধাতব মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়।
নাইজেরিয়ার প্রাচীন মুদ্রা
ভারতবর্ষে প্রথমে তামার মুদ্রার প্রচলন হয়। মনে করা হয়, ২ হাজার ৪শ বছর আগে সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের শাসনামলে এ মুদ্রার প্রচলন হয়। তখন ধাতু গলিয়ে পাতলা পাত বানিয়ে সেটি কেটে মুদ্রা বানানো হতো। মুদ্রার উভয় পিঠে থাকতো নানা ধরনের ছাপ। ধাতু গলিয়ে সবাই মুদ্রা বানালে কেউ কারোরটা গ্রহণ করবে না। এ কারণে ছাপ দিয়ে সরকারি মুদ্রা বানানো হতো। যাতে এগুলো নকল করা না যায়।
প্রাচীন মুদ্রা
এরপর ভারতবর্ষ বিভিন্ন রাজবংশ শাসন করেছে। বিদেশিরা দখলে নিয়েছে এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। প্রত্যেকেই নিজ নিজ ডিজাইনে ধাতব মুদ্রা চালু করেছে। তবে এতে কিছুটা আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে বৃটিশ শাসনামলে।
বাংলাদেশে আলাদাভাবে ধাতব মুদ্রা চালু করেন রাজা গিয়াস উদ্দিন ইওয়ার খলজি। সেটি প্রায় এক হাজার বছর আগের কথা।
প্রাচীন চীনা কাগুজে
টাকা বলতে সাধারণত কাগজের নোটকে বুঝে সবাই। ধাতব মুদ্রায় বিনিময়ের সীমাবদ্ধতা কাটাতে কাগজের নোটের প্রচলন হয়। ধাতব মুদ্রা তৈরি করা বেশ কষ্টসাধ্য। এতে খরচও হয় অনেক। আবার অনেক ওজন বলে বহন করাও সহজ নয়। এর সমাধানে বিকল্প হিসেবে উঠে আসে কাগজের নোট।
ধাতব মুদ্রার মতো কাগজের নোটের উৎপত্তি নিয়েও কিছু বিতর্ক আছে। তবে বেশিরভাগ গবেষক মনে করেন চিন দেশে প্রথম কাগজের নোটের প্রচলন শুরু হয়। এটিও প্রায় ৩ হাজার বছর আগের কথা। পরে ধীরে ধীরে বিভিন্ন দেশে কাগুজে মুদ্রার প্রচলন হয়েছে।
সাধারণত প্রত্যেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাগজের নোট ছাপিয়ে বাজারে ছাড়ে। সে নোটে থাকে নানা ধরনের ডিজাইন। ব্যাংক গভর্নরের স্বাক্ষর। আমাদের দেশে বাংলাদেশ ব্যাংক এ মুদ্রা ছাপিয়ে থাকে। তবে এক ও দুই টাকার মুদ্রা বাজারে ছাড়ে অর্থমন্ত্রণালয়।
নোট যাতে নকল হতে না পারে সে জন্য নানা ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। নোটের ভেতরে থাকে একটি নিরাপত্তা সুতা। থাকে রঙের কিছু কারুকাজ। মনোযোগ দিয়ে এসব দেখলে আসল ও নকল টাকার পার্থক্য করা সম্ভব।
চমৎকার লিখেছেন। টাকা আবিষ্কারের অনেক কিছু জানতে পারলাম। চালিয়ে যান।
thanks