যুবলীগ ক্যাডারের টর্চারসেলে দুই বছরে নির্যাতিত ২ শতাধিক মানুষ
যুবলীগ ক্যাডারের টর্চারসেলে দুই বছরে নির্যাতিত ২ শতাধিক মানুষ
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার যুবলীগ ক্যাডার নাজিম মাহফুজ ওরফে অপু সিকদারের টর্চারসেলে গত দু’বছরে দুই শতাধিক লোক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নির্যাতনে কেউ পঙ্গু আবার কেউ শয্যাশায়ীও হয়েছেন।
উপজেলার গোচরা চৌমুহনী বাজারে একটি দোকান ঘরকে টর্চারসেল বানিয়ে সাধারণ মানুষকে ধরে চালানো হতো নির্যাতন। শুক্রবার সর্বশেষ নির্যাতনে মারা গেছেন আবদুল হামিদ নামে এক যুবক। মূলত এ ঘটনার পর থেকে ভুক্তভোগী ও নির্যাতিতরা মুখ খুলতে শুরু করেছেন।
এদিকে আবদুল হামিদ হত্যার ঘটনায় গিয়াস উদ্দিন নামে এক ব্যক্তিকে পুলিশ শনিবার রাতে গ্রেফতার করেছে। রোববার বিকালে তাকে আদালতে সোপর্দ করা হয়। আবদুল হামিদ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার দায় স্বীকার করে গিয়াস উদ্দিন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদুল হাসানের আদালতে জবানবন্দিতে গিয়াস এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুবলীগ ক্যাডার নাজিম মাহফুজ ওরফে অপু সিকদারসহ আরও ৫-৬ জন জড়িত রয়েছে বলে স্বীকার করেছেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রাঙ্গুনিয়া থানার ওসি তদন্ত আবুল কালাম আজাদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
অপুর টর্চারসেলে নির্যাতনের শিকার একজন হচ্ছেন পোমরা ইউনিয়নের বাদাসা নগরের নুর হোসেনের ছেলে ইব্রাহিম। অপু সিকদারের ডাকে সাড়া না দেয়ায় গত বছর টর্চারসেলে ধরে নিয়ে তাকে নির্যাতন করা হয়। ইব্রাহিমের এক চাচাতো ভাই যুগান্তরকে জানান, ‘দুপুরের দিকে ৭-৮ জন লোক অতর্কিতভাবে তাকে ধরে নিয়ে যায় গোচরা চৌমুহনী এলাকার টর্চারসেলে।
সেখানে হাতুড়ি, কাঁটাতার এবং লোহার রড দিয়ে বেধড়ক পেটানো হয় তাকে। পরে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে ভর্তি করানো হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে। সেখানে ১৫-২০ দিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। ইব্রাহিমের ফুফাতো ভাই আবুল কাসেমের ছেলে কামালকেও টর্চারসেলে ধরে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়।
পোমরা ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান ইউপি সদস্য মো. আবু তাহের যুগান্তরকে বলেন, দু’বছর আগে গোচরা চৌমুহনী বাজারে অপু তার ৭-৮ জন অনুসারীকে নিয়ে আমার ওপর হামলা চালায়। দোকান থেকে বাটখারা নিয়ে আমার শরীরে আঘাত করে এবং কয়েকজন বোতল ভেঙে শরীরে ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে।
পরে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় আমি প্রাণে বাঁচি। তবে গুরুতর আঘাত পাওয়ায় চিকিৎসার জন্য আমাকে ভর্তি হতে হয় চমেক হাসপাতালে। পুনরায় হামলায় ভয়ে আমি আর থানায় মামলা করিনি। আমার অপরাধ ছিল- পোমরা এলাকার একটি দুর্গাপূজায় অপু তার লোকজন নিয়ে মদ খেয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছিল, আমি তাতে বাধা দেই।
পোমরা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য মো. মহসিন যুগান্তরকে জানান, ‘কোনো কারণ ছাড়াই অপু দলবল নিয়ে আমার ওপরও কয়েক দফা হামলা করে আহত করে। হামলায় আমি আহত হলেও তার বিরুদ্ধে ভয়ে থানায় কোনো অভিযোগ করিনি। কেননা সে অত্যন্ত খারাপ প্রকৃতির লোক।’
গত মাসে গোচরা বাজারের চা-দোকানি মো. নাজিমের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে অপু। চাহিদামতো টাকা দিতে না পারায় তাকে এ ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য করেছে। গোচরা চৌমুহনী বাজার কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও গাউসিয়া ফার্নিচারের মালিক মো. আজিম জানান, বিভিন্ন সময়ে অপু তার লোকজন নিয়ে এসে চাঁদা দাবি করত। চাহিদামতো চাঁদা না দিলে লাঞ্ছিত করত। এমনকি দোকান থেকে জোর করে কাঠ নিয়ে বিক্রিও করে দিত।
এ ছাড়া গোচরা এলাকার মেহেরুজ্জামানের ছেলে বাদশা, গোচরা চৌমুহনী বাজারের জেনারেটর চালক মো. কামাল, গোচরা চৌমুহনীর মিন্টু সওদাগর, দিদারুল আলম, চা দোকানি খোকন, পোমরা মাইজপাড়া গ্রামের আবদুল্লাহ, আজিম নগরের কাঠমিস্ত্রি মোরশেদ ও ব্যবসায়ী কমিটির সদস্য মো. শাহীনসহ প্রায় দু’শ’ নিরীহ মানুষকে গত দুই বছরে অপুর টর্চারসেলে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে।
তার কবল থেকে রেহাই পায়নি পোমরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও গোছরা চৌমুহনী বাজার কমিটির সভাপতি জাহেদুল ইসলামও। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘অপুর কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নেই। এক সময় বাজারে তার একটি চায়ের দোকান ছিল। তিন বছর ধরে সেটিও নেই। তাকে বাজার কমিটিতে স্থান না দেয়ার কারণে আমাকে নানাভাবে হুমকি-ধমকি দেয়। পরবর্তীতে তাকে বাজার কমিটির সহসভাপতি পদে রাখা হয়।’