"চোখের বালি"
রাত গভীর হয়েছে। তবে গল্পটা ফুঁড়োয়নি। শবে মাত্র শুরু।
রাস্তার পাশে ক্ষুদ্র ঘর, ভেতরে একটা প্রাণ। চোখে ঘুম নেই, বসে আছে আনমনে।
কিছু না বুঝেই হাতে সিগারেট তুলে নেই। আশেপাশে দিয়াশলাই এর খুঁজ। এইতো, পড়ার টেবিল এর উপরে দিয়াশলাই বক্সটা। সিগারেট এ আগুন জ্বলছে; পেছন থেকে কেউ একটা বলে ওঠে, চলে বাইরে যাই।
সিগারেট ঠোটে নিয়ে ঘরের বাইরে। পায়ের জুতোজোড়া পড়েই রাস্তায় গিয়া দাঁড়ালাম। আশেপাশে সব স্তব্ধ। শুধু একফালি চাঁদ, তাকে ঘিরে গুটাকয়েক তারা।
অন্ধকার তেমন নেই।
গ্রামের পরশের একটা অনুভব গভীর রাতে। রাস্তার পথচলা বাড়ির সামন দিয়ে উত্তরে-দক্ষিণে। বাড়ির ঠিক দক্ষিণে কাঠ বাগান। তার একটু এগুলে কবরস্থান, পাশে মস্ত বড় একটা বটগাছ।
দিনের আলোতে গাড়িদের আনাগোনা থাকলেও রাতের বেলা তাদের তেমন একটা দেখা মেলেনা।
হাটতে হাটতে বটগাছের তলে। হাতের সিগারেট শেষ হয়ে ফিলটার এর আগুন লেগে গেছে। হাত থেকে সিগারেট এর ফিলটারটা ফেলে ডেকে ওঠি; আমিও ঘুমাবো তোমাদের সাথে, তোমাদের কোনো সমস্যা নেই তো?
প্রশ্নটা আর কাউকে নয়, কবরকে।
কোনো উত্তর মেলেনি তখন। কিছুক্ষণ আনমনা দাঁড়িয়ে থেকে ঢুকে পরি কবরস্থানে। সব গুলো কবর একটা একটা গুনে তারপর আবার সেই বটতলে।
আকাশের চাঁদটা আজ দেখতে ভারি সুন্দর। চাঁদ দেখতে বসে পড়ি বটগাছের গা ঘেঁষে।
চাঁদের আলোতে নিজের মনকে পরিশুদ্ধ করতে আপ্রাণ চেষ্টা। কারণে ঘুমোবার আগেই নিজেকে একটু ভালো দেখতে চাই।
চারদিকে মৃদু বাতাসের আগমন। বটের ডালে পেঁচাদের বসবাস। দু'একটা বাতাসের কারণে নড়ে ওঠে। এতে করে আমার ভয় হয়না।
শুধু এক পলকে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকা। কেমন একটা ঘুম-ঘুম ভাব। বাতাসের স্পর্শে বটের তলেই চিরদিনের জন্য ঘুমোতে ইচ্ছে করে। কেউ যেন আর ডাকতে না পারে, ওপারের পৃথিবী দেখতে ইচ্ছে করে। তবুও ঘুম আসেনা।
ছোটবেলায় অনেক গল্প শুনেছি এক বটতলা আর কবরস্থান নিয়ে। তখন দিনের বেলাতেও একা এ দিকদিয়ে আসা হতো না। তবে এখন এ গল্পগুলো মিথ্যে মনেহয়। মনেহয় এখানের শান্তিগুলো লুকিয়ে রাখতেই কেউ আমায় মিথ্যে গল্প বলেছিলো। তাতে কি, আজ আমি সেই গুপ্ত শান্তি নিজেই খুঁজে বেরকরেছি।
ঘড়ির কাটায় সময় হয়তো ৩টা বাজে প্রায়। তবুও ঘুম পায় না আজ। কারণ এযে পরম শান্তি; ঘুমোলেই হারিয়ে যাবে। তাই দুচোখ আজ ঘুমোতে চায় না।
পাশের বাড়ির একটা কুকুর আছে। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে ছুটে আসে বটতলে।
আমি ওকে ডেকে বলি, কথা বলিস না, চল দুজনে বসে থাকি। কুকুর আমার কথা শুনেনা। শুধুই ডেকে যায়। একটু রাগ হয় আমার। উচ্চ গলায় বলে ওঠি; যা তো তুই! অযথা রাগাসনে আমায়।
তখন মনে পড়লো, ঘর থেকে কেউ একটা আমায় ডেকে এনেছিলো, কে ছিলো? মনেও পড়ছেনা।
থাক, মনে না থাকলে নেই। তাকে আর কি বা দরকার! একাই তো বেশ আছি। সে আসলে হয়তো এতোটা শান্তি পেতাম না। এদিক থেকে ভালোই হয়েছে।
পূর্ব আকাশের তারা গুলো দেখতে একটু বড়। ওরা মনেহয় আগে জন্মেছিল। তাই বেশি বড়।
চাঁদের সাথেই আমার যত কথা। তবুও চোখে ঘুম আসেনা। ইচ্ছে করে চিৎকার করে ঘুমিয়ে ডাকা সবাকে বলি; তোমরা এতোটা সুখ আছো, তবুও আমায় কেন ডাকোনি? চিৎকার করিনি।
ভাবলাম ওদের ডাকলে আবার তো সেই কলরব। তার থেকে চুপ থাকাই ভালো। এমন কত শত কথার ভীড় হলো মনে।
"ঐতো সেদিনের ছোট্ট মেয়েটা, যে কিনা পৃথিবীর আলো দেখার আগেই চলে গিয়েছিলো ওপারে। সেও ঘুমিয়ে আছে এখানেই।"
আমিই তো নিজের হাতে তাকে শুয়িয়ে দিয়েছিলাম।
আজ তাহলে কেন আমার ঘুম আসেনা? তাহলে কি ওরা আর আমি ভিন্ন?
ভিন্ন! তা কি করে হবো? সবাই তো মাটির তৈরি। তবে কেন ওরা ঘুমোচ্ছে; আমি জেগে আছি?
ভাবতে ভাবতে কখন যে বটতলেই ঘুমিয়ে পড়ি।
প্রভাতে গায়ের কাথা টেনে দিয়ে ছোট বলে, 'ভাইয়া পড়তে বসবি না? ৯টা বেজে গেছে; তোর না ২ তারিখ পরীক্ষা!'