একফালি চাঁদ
আমার মাথায় প্রচুর উকুন, এটা জানার পরেও কি তুমি আমায় ভালোবাসবে?'
মিলির কথা শুনে আমি রেগে যাই। ওর দিকে পাশ ফিরে তাকিয়ে থাকি একমুহূর্ত। এই মেয়েটাকে আমি ঠিক বুঝতে পারি না। এত উদ্ভট কথা বলে কী এমন মজা পায় সেটাও জানি না।
সেদিন যেমন ফোন করে হুট করে বলে বসলো, 'আসিফ, তুমি কখনো টিকটিকির বাচ্চা দেখেছো? একদম ছোট্ট বাচ্চা। এই মনে করো, ডিম থেকে ফুটে বের হওয়ার পর যেমন দেখা যায়, ঠিক তেমন।'
আমি অতশত না ভেবে বললাম, 'হ্যাঁ, দেখেছি বোধহয়।'
আমার এই হ্যাঁ বলাটাই যেন কাল হয়ে দাঁড়ালো। শুরু হলো, 'কোথায় দেখলাম, কেমন কালার, কতটুকু সাইজ ব্লা ব্লা ব্লা...। শেষ পর্যন্ত ক্ষান্ত হলো এই বলে যে, জন্মদিনে তাকে একটা পিংক কালারের টিকটিকির বাচ্চা গিফট করতে হবে।'
আমি পড়ে গেলাম মহা মুশকিলে। টিকটিকির বাচ্চা কোথায় পাবো, তার উপর আবার পিংক কালার!
আর সবচেয়ে চিন্তার বিষয় মিলির জন্মদিন কবে সেটা আমার মনেই নেই। এই কথা যদি মহারানী জানতে পারে তাহলে তো তুলকালাম বাধিয়ে বসবে।
.
আমার চুপ করে থাকা দেখে ও আবার বলে ওঠে, 'কী ব্যাপার, কথা বলছো না কেন? তোমার কি আজ মৌনব্রত?'
আমি এবার মুখ খুলি।
মেয়েটা কাচুমাচু মুখ করে এখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছে, যেন অতি সিরিয়াস প্রশ্নের সিরিয়াস উত্তর চাই তার।
ওকে আশ্বস্ত করে বলি, 'মাথায় উকুন হলে উকুন নাশক শ্যাম্পু কিনে দেবো, দরকার হয় মাথার চুল কেটে ন্যাড়া বানিয়ে দেবো; কিন্তু ভালো কেন বাসবো না বলো? এটা কী ধরনের প্রশ্ন?'
আমার উত্তরে ও বিশেষ খুশি হয় বলে মনে হয় না। গলার স্বর আগের থেকেও গম্ভীর করে বলে, 'তুমি কি সত্যিই আমায় ভালোবাসো?'
আমি বেশ বুক ফুলিয়ে জবাব দিই, 'কেন সন্দেহ আছে?'
ও চোখ নিচের দিকে নামিয়ে নিতে নিতে বলে, 'কিন্তু আমার তো সেটা মনে হয় না।'
'তোমার তাহলে কী মনে হয়?'
'তুমি আমায় একটুও ভালোবাসো না।'
'সেটা তোমার ভুল ধারণা মিলি।'
'আমি ভুল, সেটা বলতে চাইছো?'
'তুমি ভুল সেটা কখন বললাম?'
'তারমানে আমি ঠিক?'
'অবশ্যই, একশবার ঠিক।'
'তাহলে তুমি আমায় ভালোবাসো না, এটা সত্যি?'
'সেটা কেন হতে যাবে?'
'সেটাই তো হচ্ছে।'
'মহা মুশকিলে পড়া গেল তো।'
আমার করুণ মুখ দেখে মিলির দয়া মায়া কিছু হয় কিনা জানি না, তবে নতুন করে আর কিছু বলে না। এই যা স্বস্তি।
আমি আলতো করে ওর হাতের উপর হাত রাখি। মৃদুস্বরে ওর নাম ধরে ডাকি, 'মিলি...'
ও স্বভাবতই উত্তর নিয়ে বলে, 'হু শুনছি। কিছু বলবে?'
'মিলি, তোমার কি মন খারাপ?'
'মন নেই যে খারাপ থাকবে।'
'এতদিন জানতাম তুমি দানশীল। কিন্তু এইভাবে নিজের মনটাও যে কাউকে দান করে দেবে বুঝতে পারিনি। ফেরত নেওয়ার কি কোনো উপায় নেই?'
কথাটা বলে আফসোসের সুরে মুখ দিয়ে টাহ্ করে শব্দ করি।
আমার রসিকতায় ওর রাগ কমার বদলে আরও বেড়ে দ্বিগুণ হয়। কাঠ কাঠ গলায় জবাব দেয়, 'না তো আমি ফাজলামো করছি, না তো ফাজলামো আমার পছন্দ।'
'তারমানে তোমার সিরিয়াস কোনো কারণে মন খারাপ? তাই তো?'
'জানি না।'
'কোনো ব্যাপার না। আমিই উদঘাটন করে বের করছি। কিন্তু কী এমন সিরিয়াস ঘটনা হতে পারে? আচ্ছা, আজ কি তোমার দাদার মৃত্যুবার্ষিকী?'
'আমার দাদা এখনো বেঁচে আছেন আসিফ।'
'তাহলে তোমার দাদার দাদার মৃত্যুবার্ষিকী?'
'তিনি আমার দাদার জন্মের কয়েক বছর পরেই মারা গেছেন। এত বছর বাদে নিশ্চয়ই আমি তার জন্য শোক পালন করবো না৷ এসব সস্তা জোক্স একদম আমার সাথে করবে না বলে দিলাম।'
'তাহলে কী কারণে মন খারাপ সেটা তো বলো?'
'আজ কয় তারিখ?'
'১৪ই ফেব্রুয়ারি। কেন?'
'তোমার প্রেমিক হওয়ার কোনো যোগ্যতা নেই, হাজবেন্ড তো নয়ই।'
'তারিখের সাথে আবার এগুলোর কী সম্পর্ক?'
ও কোনো উত্তর না দিয়ে বিছানা থেকে উঠে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। ওকে রাগানো জন্য শুনিয়ে শুনিয়ে বলি, 'আজ রান্নাটা বোধহয় তোমার রাগের আগুনেই হবে। যাক গ্যাসের বিল কিছুটা কমলো।'
সারাদিন অফিস শেষে বাড়ি ফেরার পথে খেয়াল হয় একদল তরুণ তরুণী সেজেগুজে হাত ধরে ঘুরে বেরাচ্ছে, একে অপরের সাথে প্রেম বিনিময় করছে। আমি অজান্তেই হেসে ফেলি। মনে পড়ে, 'আজ তো ভালোবাসা দিবস'।
কী অদ্ভুত! ভালোবাসতে আবার আলাদা দিনক্ষণ লাগে। এই সস্তা স্রোতে গা ভাসিয়ে মিলিও কিনা শুধু শুধু আমার সাথে রাগারাগি করে। আমার নাকি প্রেমিক হওয়ার যোগ্যতা নেই। কোনো মানে হয়! ও খুঁজলেও কি আমার মতো আরেকটা আসিফ পাবে?
.
ঘরে ঢুকেই দেখি মিলি নিজের মতো কাজ করছে। আমাকে দেখেও যেন না দেখার ভান করে চুপ আছে। অভিমানটা এখনও পড়েনি তাহলে!
মেয়েটা কারণে অকারণে গাল ফুলিয়ে অভিমান করে কী যে এত মজা পায়, সেটা জানি না। তবে মিলি রাগলে আমার ভালো লাগে, অভিমান করলেও ভালো লাগে; আর সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে ও যখন হাসে। মোটকথা, ওর অস্তিত্বের উপস্থিতিটা আমি উপভোগ করি।
.
ঘর গোছানোর সময় পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরি৷ ও মৃদু প্রতিবাদ করতে গিয়েও চুপ হয়ে যায়। চোখেমুখে কৃত্রিম রাগ এনে বলে, 'আহ কী হচ্ছে? দেখছো না কাজ করছি?'
'কাজ করতে হবে না। তুমি এখন আমার সাথে প্রেম করবে।'
'আদিখ্যেতা দেখলে বাঁচি না। ছাড়ো তো।'
আমি এবার ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলি, 'ভালোবাসি মিলি। সত্যিই অনেক ভালোবাসি তোমায়।'
এতক্ষণে মনে হয় মহারানীর অভিমান ভেঙেছে। চোখেমুখে দুষ্টুমিভাব এনে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলে, 'এতই যদি ভালোবাসো তাহলে বলো তো আমার জন্মদিন কবে?'
আমি অসহায় মুখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার অবস্থা দেখে ও হাসে, আমি মুগ্ধ হয়ে সেই হাসি দেখি।
ও কিছু বলার আগেই আমি নিজের বাহুডোরে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি। চোখের দিকে তাকিয়ে বলি, 'মনে করো, তোমার জন্মদিন আমার মনে নেই, তোমাকে কিছুই গিফট দিতে পারলাম না; তাহলে কি ভালোবাসবে না আমায়?'
ও কোনো উত্তর দেয় না। ছোট্ট বিড়ালছানার মতো বুকের ভেতর লুকিয়ে পড়ে। ওর এই কিছু না বলাটা আমার ভালো লাগে। কিছু না বলেও যেন কতকিছু বলা যায়। এটাই হয়তো ভালোবাসা।
মিলি হঠাৎ বুক থেকে মুখ তুলতে তুলতে বলে, 'বুঝতে পেরেছি, কথা ঘুরাচ্ছো। টিকটিকির বাচ্চা না দেওয়ার ধান্দা।'
আমি প্রসঙ্গ বদলে বলি, 'টিকটিকির বাচ্চার বদলে যদি তোমার কোলজুড়ে একটা বাচ্চা দিই, ভালো হবে না?'
'তুমি ভীষণ অসভ্য...'
কথাটা বলেই ও মৃদু ধাক্কা দিয়ে ছিটকে পালিয়ে যায়।
ওর লজ্জা-লজ্জা মুখের মধ্যে কেমন একটা স্নিগ্ধতা কাজ করে। দেখতে ভালো লাগে।
জানালা দিয়ে চাঁদের আলো যেন ঠিকরে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। আমি আলোদের খেলা দেখি না, আস্ত একটা চাঁদ দেখি। সেই চাঁদের নাম মিলি। আমার ভালোবাসা, আমার অস্তিত্ব।