বীরবল মণ্ডল
ক্লাস করে রুমে ফিরেছি এইমাত্র।কাজটা করতে একটুও ভালো লাগে না আমার।সকালে ঘুমটা যখন গাঢ় হয়ে আমার চোখে ধরা দেয় তখনই ঘুম থেকে উঠে যেতে হয় ক্লাসে।অধিকাংশ দিন তাই আট টার ক্লাস করা হয় না।আর ক্লাসে গেলেও পেছনে বসে ঘুমিয়েই কাটে ক্লাস নোট তোলা হয় না।এভাবেই চলে যাচ্ছে আমার বুয়েট জীবনের এক একটা দিন।আজও তার ব্যতিক্রম হয় নি।সকালে ক্লাসে গিয়েছি,ক্লাসে বসে ঘুমিয়েছি এবং ক্লাস শেষে রশিদ হলের ২০১ নং রুমে চলে এসেছি।তন্দ্রাভাব সারাদিনই আমার চোখে বিরাজ করে।তাই ব্যাগটা রেখেই শুয়ে পড়লাম।কতক্ষন কেটে গেছে বলতে পারি না।হঠাৎ শুনতে পেলাম কে যেন বলছে আপনাদের রুমে কারো রক্তের গ্রুপ কি A+ve?আমার সদ্য রুমমেট হওয়া ছেলেটা বলল,হ্যাঁ দাদার রক্তের গ্রুপ A+ve।উনি ঘুমাচ্ছেন,কখনও রক্ত দেন না।আমার চোখ এখনো বন্ধ হয়ে আছে তবে শুনতে পাচ্ছি সবকিছু।আমার গড়নটা ঠিক রক্ত দেওয়ার জন্য উপযুক্ত নয়।পাতলা শরীর,একটু লম্বা আর সাইজের তুলনায় ওজন কম।কিন্তু রক্ত দিতে হলে যে সর্বনিম্ন ওজন দরকার সেটুকু আছে।অনেকটা ভীতির কারনেই কখনও রক্ত দেওয়া হয় নি। কথাটা অধিকাংশ বাঁধন কর্মী এবং আমার পরিচিতেরা জানে।চোখ খুলে দেখি ছেলেটা সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে।আমি বললাম যাকে রক্ত দিতে হবে সে তোমার কি হয়?সে বলল, ‘আমার মা’।রক্ত দেব না বলে ছেলেটাকে ফেরানোর মতো অবস্থা আমার আর থাকল না।বললাম, ‘কখন দিতে হবে,কোথায় দিতে হবে? সে বলল, ‘মেডিকেল কলেজে,এখন দিতে হবে’।তাকে বসতে বলে আমি রেডি হয়ে নিলাম।জীবনে প্রথম বারের মতো রক্ত দিতে চললাম।যেতে যেতে শুনলাম তার মা একটা গাড়ির সাথে এ্যাকসিডেন্ট করেছে গতদিন।অনেক রক্ত ঝরেছে।রক্ত লাগছেও তাই বেশি।এ পর্যন্ত ৫ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে।তবে এখন না’কি অনেকখানি সুস্থ।
রক্ত দিতে দিতে বিকাল ৩ টা বেজে গেলো।কাল আবার একটা ক্লাস টেস্ট আছে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।রুমে এসে একটা ফাটাফাটি ঘুম দেব বলে মন স্থির করেছি রক্ত দিতে দিতেই।হাসপাতালের বারান্দা দিয়ে দ্রুতবেগে হেঁটে চলেছি।হঠাৎ পাশের একটা কেবিন থেকে কান্নার শব্দ পেলাম।খুব পরিচিত কন্ঠ।আমার একটা অসাধারন ক্ষমতার কথা কেউ জানে না।যার সাথে আমার এক ঘন্টার আলাপ আছে বছরের পর বছর কেটে গেলেও তার কন্ঠস্বর আমি ভুলি না।অনেকটা দৌড়েই কেবিনে গেলাম। হ্যাঁ,যাকে ভেবেছিলাম ঠিক সেই।এই সেই শর্বরী যাকে আট বছর আগে সর্বশেষ দেখেছি।আমরা তখন একসাথে পড়তাম ক্লাস এইটে।এর সাথে কত ঘটনা জড়িয়ে আছে আমার।একে একে মনে পড়ে যায় সবই।
ঘুমের ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে বলে ঘুমিয়ে পড়েছে শর্বরী।আমার আর রুমে ফেরা হলো না।আমি ওখানে বসে রইলাম।কখন শর্বরীর ঘুম ভাঙবে সেই আশায় রইলাম।আমি আমার স্মৃতি হাতড়ে পুরনো দিনে ফিরে যাই।আমরা একসাথে স্কুলে যেতাম।গ্রামের পথে অনেক দূর হেটে যেতে হতো স্কুলে।অধিকাংশ দিন আমার বইগুলো ঐ বয়ে নিয়ে যেতো।কত মজা করতাম আমরা।একবার কি একটা অংক বুঝতে পারছিলো না বলে মেরেছিলাম আমি।সে কি কান্না শর্বরীর।এরপর প্রায় দশদিন কথা বলে নি আমার সাথে।স্কুলে যেতে আসতে কথা হতো আমাদের তবু ক্লাসে বসে চোখে চোখে কথা বলা থামত না।এর যেন মজাই আলাদা,অন্যরকম এর অনুভূতি।এইটে থাকার মাঝামাঝি সময়ে ওর বাবা হঠাৎ করে মারা যায়।এমনিতেই গরীব পরিবার তার উপর একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ে ওরা।ক্লাস নাইনের প্রথম দিনেই আমাদের এলাকার মেম্বার তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে।কি যেন একটা চাকরি দেয় ওকে।খুব কষ্ট হয়েছিলো আমার।সেই থেকেই স্বপ্ন দেখতাম একদিন ঢাকায় আসব এবং শর্বরীকে খুঁজে বের করব। চার বছর হলো ঢাকায় এসেছি।এই চার বছরে কত খুঁজেছি শর্বরীকে কিন্তু পাই নি।আশ্চর্য হলেও সত্য সেই মেম্বারের দেওয়া ঠিকানা আমি আজও ঢাকা শহরে খুঁজে পাই নি।সেই শর্বরীর সাথে আজ দেখা হয়ে গেলো।যাকে দেখার জন্য এতটা বছর অপেক্ষা করেছি তার সাথে কথা না বলে আমি যেতে পারি না।আমার হাজার কাজ পড়ে থাক্।গোল্লায় যাক্ সব।
নার্সটা রুমে এসেছে আবার।বললাম এ রুগী কবে ভর্তি হয়েছে এখানে।বলল দুই দিন আগে।রুগী কে ভর্তি করেছে বলতে পারেন।নার্স বলল,না।বললাম রুগীর কি হয়েছে?বলল,রুগী HIV +ve এ আক্রান্ত।আমি থমকে গেলাম।আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল।আমার চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে,একটু পরে স্রোতও নামল।আমার আর বুঝতে বাকী রইল না কেন চার বছর চেষ্টা করেও শর্বরীর ঠিকানা আজও আমি খুঁজে পাই নি।
বিকাল পাঁচটার দিকে ঘুম ভাঙল শর্বরীর।আমাকে দেখতেই চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে নিল সে।বুঝলাম আমাকে চিনতে অসুবিধা হয় নি ওর।আমি ওর মাথার কাছে গিয়ে বসলাম।আমার হাতটা অজান্তেই শর্বরীর মাথায় চলে যায়।সে মাথাটা আমার কোলে রেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে।আমি সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করি তবে কি যে বলব ঠিক বুঝতে পারি না।প্রায় আধ ঘন্টা পর সে হঠাৎ করে বলে ওঠে ও মানুষ না,ও আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছে।গ্রামে থেকে না খেয়ে মরতাম সেই তো ভালো ছিলো।আমার সমস্ত ঘটনাটা পুরোপুরিভাবে জানার ইচ্ছে হয়।কিন্তু শর্বরীর কাছে জানতে চাওয়ার সময় এটা নয়। আমার জানা মতে ঢাকা থেকে প্রতি মাসে তিন হাজার করে টাকা ওর মায়ের ঠিকানায় যায়।টাকাটা ঐ ঠিকানায় কে পাঠায় তা ঠিক বুঝতে পারি না আমি।
আরও কিছুক্ষন কেটে যায়।চোখ মুছতে মুছতে উঠে বসে শর্বরী।পুরো ঘটনাটা বলতে শুরু করে সে। সেদিন ঢাকায় নিয়ে আসার পর প্রথমে একটা হোটেলে নিয়ে যায় ওকে।সেখানে পাঁচদিন ঐ মেম্বার ওকে আটকে রেখে ভোগ করে।ছয় দিনের দিন ওকে একটা পতিতালয়ে রেখে চলে যায় সে।দেখতে খুবই ভালো ছিলো শর্বরী।তাই ওখানে যারা আসতো সবাই ওকেই টার্গেট করত।আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে শর্বরী।কাঁদতে কাঁদতে বলে এই আট বছরের প্রায় প্রতিটি রাতে কোন না কোন নরপশুর সাথে থাকতে হয়েছে তার।তা সে দেশী হোক আর বিদেশী।আমার বলার কিছুই নেই আজ শুধুই শোনার পালা।সে আবার বলতে থাকে গত কয়েকদিন আমার পাশে কেউ আসে না,আমি একা থাকি।রোগটা হয়ে বেঁচেই গেছি।জীবনের বাকি দিনগুলো শান্তিতে থাকতে পারব।হঠাৎ করে কি এক খেয়ালে ওর মায়ের কথা জানতে চায় সে।আমি বললাম ভালোই আছে।মাসে মাসে তিন হাজার করে টাকা যায়।ও বলল পশুটা টাকাটা দেয় তাহলে।আমি তো ভেবেছিলাম টাকাও দেবে না।এখন আমার কাছে সমস্ত রহস্যই পরিস্কার হয়ে গেছে।মেম্বার প্রায়ই শর্বরীর মতো মেয়েকে চাকরি দেব বলে ঢাকায় নিয়ে আসে।এর পরের ঘটনা আর কেউ জানতে পারে না।আজ আমি জানতে পেরেছি।সুতরাং এর ব্যবস্থা আমাকেই নিতে হবে।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে।আমাকে এখন উঠতে হবে।রক্ত দিয়ে এমনিতে শরীরটা ভালো লাগছে না।মনটাও আবার খারাপ হয়ে গেলো।একজনকে রক্ত দিয়ে যে তৃপ্তি তার পুরোটাই আজ মাটি হয়ে গেলো।আমি শর্বরীকে বলতে পারছি না আমাকে এখন যেতে হবে।আবার ওকে ছেড়ে আসতে আমার মনও চাইছে না।অনেকক্ষন ধরেই নিস্তব্ধতা ছিলো।হঠাৎ শর্বরী বলল আমাকে রিক্সায় করে একটু ঘুরাবে।আমার মনে পড়ে যায় এমন একটা কথা আট বছর আগেও একবার বলেছিলো ও।এইটে বৃত্তি পরীক্ষা দিতে খুলনায় এসেছিলাম আমরা।হোটেলের পাশাপাশি দুই রুমে ছিলাম ছেলেরা ও মেয়েরা।যেদিন পরীক্ষা শেষ হয় সেদিন করিডোরে দাঁড়িয়ে ও বলেছিলো প্রথম খুলনায় এলাম চলো না একটু ঘুরে আসি।বাইরে যাওয়া নিষেধ ছিলো আমাদের।নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের টান সবসময় বেশি।আমরা লুকিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।একটা রিক্সা নিয়ে ঘুরলাম অনেকখানি পথ।আমার এখনো মনে আছে চলার সময় সারাটা পথ সে আমার ঘাড়ে মাথা রেখে বসেছিলো।হাতটা ছিলো হাতে বাঁধা।হোটেলে ফিরে স্যারের বকুনি খেতে হয়েছিলো আমাদের।তবু স্যার তো আমাদের সে আনন্দটুকু,সে রোমান্সটুকু কেড়ে নিতে পারে নি।সেই দিন আর এই দিনের মধ্যে অনেক ব্যবধান তবু না করলাম না আমি।নার্সকে বলে ওকে বাইরে নিতে খুব বেশি অসুবিধা হলো না।রিক্সা নিয়ে ঘুরতে থাকি আমরা।আজ আর কোন কথা হয় না সেই কিশোর কিশোরীর মতো।আজ শুধুই নিস্তব্ধতা।দশটার আগে ওকে হাসপাতালে পৌঁছে দিতে হবে।সময় নেই আমারও তাই রিক্সাওয়ালা মামাকে বললাম হাসপাতালের গেটে ফিরে যাও।