......এক হ্যামিলিওনের বাঁশি ওয়ালা (২য় ও শেষ পর্ব)

in #story6 years ago (edited)

প্রথম পর্বের লিংকঃ

২য় ও শেষ পর্বঃ

যাদুকরী শিক্ষকঃ

পাঠদানের অভিনব সব কায়দা ছিল নূরু স্যারের আয়ত্ত্বে। অন্যান্য স্যারেরা যখন আমাদের পিঠ গরম করার উদ্দেশ্যে বেতের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতেন, তিনি তখন বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ছোট ছোট কাঠি বানিয়ে আনতে বলতেন আমাদের, আমরা উৎসাহের সাথে নিয়ে আসতাম। তার হাতে এই কাঠি হয়ে উঠত যাদুর কাঠি! এই কাঠিগুলো বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে, হাত বদল করে তিনি আমাদের যোগ-বিয়োগ শিখাতেন। ক্লাসরুম হয়ে উঠত খেলার মাঠ!

বার্ষিক পরিক্ষার আগে কিংবা প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার আগে কনকনে শিতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়ার খোজ নিতেন। কেউ সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে পরলে পিটিয়ে তুলে পড়তে বসাতেন। বলতেন “হারামজাদা, না পড়লে বড় হয়া মুনি(কামলা) বেচতে(খাটতে) হইব”! নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে তার কোন জুরি ছিল না।

একজন নিঃস্বার্থ সংস্কৃতি কর্মীঃ
নূরু স্যার একজন নিঃস্বার্থ সংস্কৃতি কর্মী ছিলেন। আমরা এখন যাকে এক্সট্রা কারিকুলাম বলি, উনি তা আমাদের মাঝে প্রোথিত করার জন্য নিরলস শ্রম দিয়ে গেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা না থকলেও উনি আমাদের শিখিয়েছেন জারিগান, দেশের গান, গ্রামীন খেলা ইত্যাদি। রোজ শুনিয়েছেন মজার সব গল্প, যাদের তিনি কিসস্যা বলতেন। রোজ তিনি নতুন কিসস্যা নিয়ে আসতেন। কিসস্যা শুনার লোভে আমরা স্কুল মিস করতাম না। আমাদের নিয়ে জারিগানের দল বানিয়ে অংশগ্রহণ করেছেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। নিজের পকেট থেকে রিক্সা ভাড়া দিয়েছে, দুপুরে আমাদের বাটারবন খেতে দিয়েছেন, নিজে পানি খেয়ে দিন পার করেছেন। স্কুল থেকে কোন ফান্ড পাননি কোনদিন, আমাদের কাছেও চাননি। এই কাজগুলো করতেন তিনি মন থেকে৷ খ্যাতির পিপাসা তার মাঝে দেখিনি কোনদিন। কোনদিন স্টেজে উঠেছেন বলেও মনে পড়েনা। তার স্বরচিত জারিগানে থাকত সমাজ, পিতা- মাতার প্রতি কর্তব্য, নানাবিধ সামাজিক অসংতির কথা, দেশ গড়ার প্রত্যয়ের কথা। যেমন- তার শেখানো জারিগানের স্তবক ছিল এমন “বাপের মাথায় পোজা (বোঝা) দিয়া, ছেলে হাটে ঘড়ি লাগায়া” কিংবা “ আইজকাইকার পোলাপান বাপেরে কয় উক্কা (হুক্কা) আন, মায়েরে কয় কোটনা বুড়ি বওয়েরে কয় সোনার চান” [প্রাসঙ্গিক কারনেই রিপিট করা হল] আর স্তবক শেষ হতো দেশ গড়ার প্রত্যয় দিয়ে “সোনার বাংলা স্বাধীন হলো, গড়তে হবে ভাই”। তিনিই প্রথম শিখিয়েছিলেন বাবা-মা, শিক্ষক ও মুরুব্বীদেরকে কিভাবে সম্মান করতে হবে, নির্দেশনা দিয়েছিলেন বিশেষ দিন গুলুতে তাদের কদমবুসি করার জন্য। আমাদের পবিত্র মনে গেথে গিয়েছিল কথাগুলো।

একজন শখের রন্ধন শিল্পীঃ
গ্রামীন পিঠা-পুলির উপর ছিল তার প্রবল আকর্ষণ আর প্রস্তুত প্রনালীর উপর অসামান্য দখল। পিঠা প্রস্তুত সম্পর্কিত বিষয়ে গ্রামের মানুষকে আগ্রহভরে সহায়তা করতেন।

একজন পল্লী চিকিৎসকঃ
নূরু স্যারকে মানুষ নূরু মাষ্টার হিসেবে যতটুকু চিনত, তার চেয়ে বেশি চিনত নূরু ডাক্তার হিসেবে। গ্রামের বাজারে তার একটি শ্রী-হীন ডিসপেনসারি ছিল। একটি জীর্ণ সেল্ফে কিছু কৌটায় বিভিন্ন ঔষধ, রোগী বসার জন্য একটি বেঞ্চ আর একটি হাতল ভাংগা চেয়ার তার নিজের জন্য। কৌটায় এলোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি ও আয়ুর্বেদ জাতীয় বিভিন্ন রকম ঔষধ থাকত। কোন রুগীকে তার ডিসপেনসারি থেকে খালি হাতে ফিরতে হয়নি। টাকা থাক আর না'ই থাক, কৌটা থেকে কিছু ঔষধ কাগজের টুকরায় মুড়িয়ে হাতে তুলে দিতেন। তার এই ডিসপেনসারি নিয়া গ্রামের লোকজন টিটকারী করত প্রায়ই। তিনি নাকি সব রোগের জন্য একই কৌটা হতে ঔষধ দেন! অথচ রাত বিরাতে যে কোন সমস্যায় নূরু ডাক্তার ছাড়া কাওকে খুজে পাওয়া যেত না। তিনি ছিলেন এমনই, অসহায় লোকদের শেষ ভরসা জায়গা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই কাজটি নিষ্ঠার সাথে করে গেছেন।

সম্মুখ সমরে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধাঃ
একাত্তরে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তার হাড্ডি সর্বস্ব শরিরে রাইফেল চালিয়েছেন শত্রু সেনাদের বিরুদ্ধে। সো-কল্ড জাল মুক্তিযোদ্ধাদের মত আজাইরা ফাপরবাজি করেন নি কখনো, চান নি নিতে কোন ব্যাক্তিগত সুবিধা। আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের অগুনতি গল্প শুনিয়েছেন যা শৈশবেই আমার রক্তে শিহরণ জাগাত। দিয়েছিলেন দেশ প্রেমের মন্ত্র।

জীবন যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকঃ
পুষ্প যেমন আপনার জন্য ফুটে না, তেমনি স্যার ও হয়ত নিজের জন্যে জন্মান নি। ব্যাক্তিগত জীবনে স্যারকে সীমাহীন কষ্ট করতে দেখেছি। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে ক্ষেতে যেতেন, স্কুলের আসার আগ পর্যন্ত কাজ করে তারাহুরা করে স্কুলে আসতেন। স্কুল শেষ করে রাত অব্দি বসতেন ডিসপেনসারিতে। কষ্টে শিষ্টে চেষ্টা করেছেন ছেলে মেয়েদের মানুষ করতে। অনেকটা সফলতার দ্বারে পৌছেও ছিলেন, কিন্ত জীবনমঞ্চ যে ট্রাজেডি ঠিক করে রেখেছিল! পড়াশুনা শেষ করার পর পরই একমাত্র ছেলেটির মানসিক ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। সংসারে দেখা দেয় আরো বিশৃঙ্খলা। এই টানাপোরেনের মাঝেই এই পৃথিবী নামক রঙ্গমঞ্চ থেকে নীরবে বিদায় নিলেন আমাদের প্রিয় নুরু স্যার। তার প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ পাওয়া আমাদের মত শিক্ষার্থী ছাড়া কেউ জানলোও না আমরা কি হারিয়েছি, কাকে হারিয়েছি!

সব শেষে এই শুধু বলতে চাই "স্যার, পরপারে ভাল থাকুন, আমাদের যদি কোন পূন্য থেকে থাকে তার বিবিময়ে হলেও আপনার ঋনের কিছুটা শোধ করার সুযোগ চাই বিধাতার কাছে।"nuru sir.jpg
ছবিঃ প্রিয় নূরু স্যার।
ছবির উৎসঃ

Sort:  

Congratulations @layesmia! You received a personal award!

Happy Birthday! - You are on the Steem blockchain for 2 years!

You can view your badges on your Steem Board and compare to others on the Steem Ranking

Do not miss the last post from @steemitboard:

SteemitBoard Ranking update - A better rich list comparator
Vote for @Steemitboard as a witness to get one more award and increased upvotes!

Congratulations @layesmia! You received a personal award!

Happy Birthday! - You are on the Steem blockchain for 1 year!

Click here to view your Board

Support SteemitBoard's project! Vote for its witness and get one more award!