বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে কী সুফল?কখন বাংলাদেশের স্যাটেলাইটে অবথিত
আগামীকাল বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে মহাকাশে যাচ্ছে দেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১। বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট নিয়ে সাধারণ মানুষের জানার আগ্রহ চোখে পড়ার মতো। সফলভাবে মহাকাশে গেলে বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইটের মালিক হবে বাংলাদেশ। কিন্তু অনেকেরই জিজ্ঞাসা, প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করা এই স্যাটেলাইট দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের আসলে কী সুবিধা হবে?
তিন ধরনের সুফল দেশের মানুষ পেতে পারে এ স্যাটেলাইট থেকে। প্রথমত, এ স্যাটেলাইটের সক্ষমতা বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও সাশ্রয়—দুটিই করা যাবে। দ্বিতীয়ত, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ সেবার সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে। তৃতীয়ত, দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলা ও ব্যবস্থাপনায় দারুণ কার্যকর ভূমিকা রাখবে এই স্যাটেলাইট। এ ছাড়া জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজেও এ স্যাটেলাইটকে কাজে লাগানো সম্ভব।
তবে এসব সম্ভাবনাকে ছাড়িয়ে যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, সেটি হলো বাংলাদেশের ভাবমূর্তি। বঙ্গবন্ধু-১-এর মাধ্যমে স্যাটেলাইট প্রযুক্তির অভিজাত দেশের ক্লাবে বাংলাদেশ প্রবেশ করবে। বঙ্গবন্ধু-১ তৈরির ঘোষণা আসার পরপরই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ন্যানো স্যাটেলাইট প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করে। ব্র্যাক অন্বেষা নামের এই ন্যানো স্যাটেলাইটটি তৈরি করেছেন এ দেশেরই কয়েকজন তরুণ। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চারজন ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রকল্পে কাজ করছেন। এ তরুণেরা বলছেন, সরকারের দিক থেকে কিছুটা সহযোগিতা পেলে ২০২১ সালের মধ্যে দেশেই স্যাটেলাইট তৈরি করা সম্ভব। তাঁরা মনে করেন, নিজেদের স্যাটেলাইট তৈরি হওয়ার কারণেই এমন বড় স্বপ্ন ও চিন্তাভাবনা করতে পারছেন।
এবার আসা যাক স্যাটেলাইটের বাণিজ্যিক দিকে। এখন দেশে প্রায় ৩০টি স্যাটেলাইট চ্যানেল সম্প্রচারে আছে। এসব চ্যানেল সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে স্যাটেলাইট ভাড়া নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। এ জন্য প্রতি মাসে একটি চ্যানেলের ভাড়া বাবদ গুনতে হয় তিন থেকে ছয় হাজার মার্কিন ডলার। সব মিলিয়ে স্যাটেলাইটের ভাড়া বাবদ বছরে চ্যানেলগুলোর খরচ হয় ২০ লাখ ডলার বা প্রায় ১৭ কোটি টাকা। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট চালু হলে এই স্যাটেলাইট ভাড়া কমবে। আবার দেশের টাকা দেশেই থেকে যাবে।
শুধু তা-ই নয়, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ট্রানসপন্ডার বা সক্ষমতা অন্য দেশের কাছে ভাড়া দিয়েও বৈদেশিক মুদ্রা আয় করার সুযোগ থাকবে। এই স্যাটেলাইটের ৪০টি ট্রানসপন্ডারের মধ্যে ২০টি ভাড়া দেওয়ার জন্য রাখা হবে বলে সরকার থেকে বলা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে এই স্যাটেলাইটের ট্রান্সপন্ডার বিক্রির জন্য সরকারের গঠন করা বঙ্গবন্ধু কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি (বিসিএসবি) লিমিটেড কাজ শুরু করেছে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের আরেকটি বিক্রয়যোগ্য পণ্য হবে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথ। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটে মোট ৪০টি ট্রান্সপন্ডারের মধ্যে ২৬টি কেইউ-ব্যান্ড ও ১৪টি সি-ব্যান্ড। প্রতিটি ট্রান্সপন্ডার থেকে ৪০ মেগাহার্টজ হারে তরঙ্গ বরাদ্দ (ফ্রিকোয়েন্সি) সরবরাহ পাওয়া সম্ভব। এ হিসাবে ৪০টি ট্রান্সপন্ডারের মোট ফ্রিকোয়েন্সি ক্ষমতা হলো ১ হাজার ৬০০ মেগাহার্টজ। কিছু কারিগরি সীমাবদ্ধতার কারণে এই ১ হাজার পুরোটা ব্যবহার করা যাবে না। তবে কমপক্ষে ১ হাজার ৪০০ মেগাহার্টজ ব্যবহার করা সম্ভব হবে।
তবে স্যাটেলাইটের ব্যান্ডউইডথ ও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে যে ইন্টারনেট পাওয়া যাবে, তা বেশ ব্যয়বহুল। ফাইবার অপটিক দিয়ে সরবরাহ করা ব্যান্ডউইডথের তুলনায় স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রিত ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথের খরচ প্রায় ১০০ গুণ বেশি। দেশের ৭৫০ ইউনিয়নে এখন ফাইবার অপটিক ইন্টারনেটের সংযোগ নেই। ইন্টারনেটবঞ্চিত এমন এলাকার মধ্যে রয়েছে পার্বত্য ও হাওর অঞ্চল। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব, যদি সরকার এই খাতে বিশেষ প্রণোদনা দেয় ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
ঝড় বা বড় ধরনের দুর্যোগে যোগাযোগব্যবস্থা সচল রাখতেও কার্যকর হবে এ স্যাটেলাইট। এ ধরনের বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোবাইল নেটওয়ার্ক অনেক সময় অচল হয়ে পড়ে। তখন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থা চালু রাখা সম্ভব হবে। সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চলের মানুষের ইন্টারনেট ও ব্যাংকিং সেবা, টেলিমেডিসিন ও দূরনিয়ন্ত্রিত শিক্ষাব্যবস্থা প্রসারেও ব্যবহার করা যাবে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট।
স্যাটেলাইটের এসব সুবিধা নিশ্চিত করতে হলে দরকার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করা। আর এ ক্ষেত্রে প্রথম উদ্যোগটি সরকারকেই নিতে হবে। স্যাটেলাইটের নিয়ন্ত্রণ ও বিপণনের কাজটিও করতে হবে দক্ষতার সঙ্গে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতকে দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগাতে হবে। সব বিষয় যাতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় না পড়ে, সেটি নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ উৎক্ষেপণের পর মুহূর্ত থেকে এ স্যাটেলাইটের মেয়াদ থাকবে ১৫ বছর। অযথা সময়ক্ষেপণ করা হলে বাংলাদেশের মানুষের কষ্টার্জিত অর্থে তৈরি এ স্যাটেলাইটের উদ্দেশ্য পূরণ কঠিন হবে।