প্রদীপ

in Incredible India2 months ago

নমস্কার বন্ধুরা। আশা করছি আপনারা সকলে সুস্থ আছেন। আজকে আমি আপনাদের সকলের সাথে আমার জীবনে প্রদীপ এর সাথে জড়িত গল্প শেয়ার করব।
ছোট থেকে কালীপুজোর সময়টা খুব সুন্দর করে আমার জীবনে কেটেছে। বিশেষ করে বড় হয়ে ওঠার পর ছোটবেলাকার কালীপুজো আমি সব থেকে বেশি মিস করি। কালীপুজোর সাথে একটি সুন্দর মুহূর্ত জড়িয়ে রয়েছে। যে মুহূর্তটি আর কোনদিনও ফিরে পাবোনা।

20241030_175106.jpg

যে মানুষটির সাথে এই পুজোটি জড়িয়ে আছে ,সে মানুষটি হল আমার দাদু। আমার ঠাকুর দাদা। আমার জীবনের সবথেকে প্রিয় মানুষ। আজ অব্দি আমার জীবনের সবথেকে সেরা একজন ব্যক্তিত্ব। আমার জীবনে যদি আমি সব থেকে বেশি কাউকে মিস করে থাকি।সেটা হলো আমার দাদু। আমার দাদু মারা গেছেন ,যখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। আমি ২০১০ সালের কথা বলছি।

20241030_164905.jpg

আপনারা বুঝতেই পারছেন আমি তখন মোটামুটি দশ বছর বয়সী।কিন্তু দাদুর সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো এর সত্ত্বেও আমার খুব ভালোভাবে মনে আছে। আসলে যে মানুষগুলি খুব কাছের হয় ,তাদেরকে ভোলা সম্ভব নয়। তাদের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো কখনোই হয়তো জীবন থেকে বের করা যায় না।

20241030_165017.jpg

কালী পূজার সময় আমি দাদুকে দেখতাম পূর্বপুরুষদের প্রদীপ দিতে। আমাদের তুলসী তলার সামনে দাদু ধুতি পড়ে বসতেন। আর সাথে আমি থাকতাম। তখন তো আমার ভাই হয়নি। দাদু চলে যাওয়ার দু'বছর ,তিন বছর পরে আমার ভাই হয়েছে। তাই সেই সময় দাদুর চোখের নয়নের মণি ছিলাম আমি। দাদু আমাকে সব সময় সাথে সাথে রাখতেন। আমাকে অত্যাধিক ভালবাসতেন। নিজের ছেলে মেয়ের মতন করে আমাকে ছোট থেকে লালন পালন করেছিলেন।

20241030_165129.jpg

প্রত্যেক কালীপুজোর দিন সন্ধ্যাবেলায় তুলসী তলায় আমিও দাদুর সাথে বসে বসে পূর্ব পুরুষদের উদ্দেশ্যে প্রদীপ দিতাম। পরবর্তীতে এই কাজ বাবাকে করতে হবে। এই কারণে দাদু আমাকে সামনে বসিয়ে রেখে দাদুর পূর্বপুরুষদের নাম সমস্তটা একটা কাগজে আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিলেন। ছোট ছোট হাতের সে লেখা, এখনো রয়ে গেছে।

20241030_165140.jpg

আজ যখন বাবাকে দেখি সন্ধ্যা বেলায় ওইভাবে প্রদীপ দিতে ,আমার মনটা কেমন ভারী হয়ে যায়। বাবার জায়গায় দাদুকে দেখতে পাই। এখন বাবার সাথে ঈশান থাকে। আর ওই সময় আমার দাদুর সাথে আমি থাকতাম।

আমার এখনো মনে আছে সবশেষে প্রদীপ দেওয়া হয়ে গেলে ,দাদু প্রণাম করে বলতে বলতেন ,যাদের প্রদীপ দেওয়া হলো না, তাদেরও যেন আত্মা শান্তি পায়। তারাও যেন যেখানেই থাকুক, সবাই সুস্থ থাকে ,ভালো থাকে।
এই মানুষকে সত্যিই আমি আর জীবনে ফিরে পাবো না। তবে তাঁর স্মৃতি সারা জীবন আমার সাথে থাকবে।

20241030_165144.jpg

আমি সত্যিই কখনো ভাবি নি ওই কাগজের পাঠাতে আরও একটি নাম জুড়ে যাবে। বাবা যখন এখন প্রদীপ দেয়। সবার আগে দাদুর নামে প্রদীপ দেয়। আর আমি সেই সিচুয়েশনটা এখনো মেনে নিতে পারি না। আমার জীবনে আমি প্রথম মৃত্যু দেখেছি নিজের বাড়িতে, সে মৃত্যু ছিল আমার দাদুর। তাই হয়তো এই ধাক্কাটা কখনোই ভুলতে পারবো না।

20241030_173151.jpg

কালীপূজা আসার আগে থেকেই আমার ঠাকুমার সাথে আমি লেগে পড়তাম ১৪ প্রদীপ তৈরি করার জন্য। আমাদের শহর মাটির পুতুলের জন্য বিখ্যাত। বাড়িতেও যেহেতু মাটির পুতুলের ছোটবেলা থেকেই কাজ হতো । তাই প্রদীপ তৈরি করা আমাদের কোন ব্যাপার ছিল না। বাড়িতেই মাটি থাকতো। আমি আর ঠাকুমা বসে বসে প্রদীপ তৈরি করতাম। তারপরে একটা কুলোয় করে ছাদে রোদে দিতাম।

20241030_165213.jpg

এই চৌদ্দ প্রদীপ শুধু নামে ১৪ প্রদীপ ছিল, প্রদীপ তৈরি করতে হতো অনেকগুলো। এখন যেমন ১৪ টা প্রদীপ তৈরি করি, আর বাকি প্রদীপগুলো বাজার থেকে কিনে নিয়ে আসি। কিন্তু তখন সবকটা প্রদীপ আমি আর ঠাম্মা বসে বসে কালীপুজোর অনেক আগে থেকে তৈরি করতে থাকতাম।

20241030_165225.jpg

কালীপূজো আসলেই ঠাম্মা, দাদুর কথা সব থেকে বেশি মনে পড়ে এই কারণে। এ কারণেই প্রদীপের সাথে আমার জীবনের একটা বড় গল্প রয়ে গেছে।। এখন বাড়িতে পুজো আসার আগে, মা, ভাই বাবা মিলে প্রদীপ বানায়।। আমার খুব দুঃখ লাগে ঠাকুমার জন্য আর দাদুর জন্য। এত মন খারাপ করে ,আমার আর বানাতে ইচ্ছা করে না এই মাটির প্রদীপগুলো।

20241030_170349.jpg

এবারে পূজোর আগের দিন ওদেরকে দেখছিলাম ওরা নিজের হাতে প্রদীপ তৈরি করছে।। আমি ছবিগুলো তুলে রেখেছি। কিন্তু একবারের জন্য প্রদীপ তৈরি করতে বসিনি। প্রদীপগুলো তৈরি হয়ে যাওয়ার পর তিনটে পাটকাঠির মাথা একটা দড়ি দিয়ে বেঁধে বেশ স্ট্যান্ড করে দেওয়া হয়। তার ওপর প্রদীপ গুলো রাখা হয়।

20241030_173147.jpg

সত্যি বলতে প্রদীপের এই গল্পটা আপনাদের সকলের সাথে শেয়ার করতে পেরে আমার মন সত্যিই হালকা লাগছে। কিছু কিছু যন্ত্রণা মনের মধ্যে প্রবল ভাবে নাড়া দেয়। বলে ফেললে সত্যিই হালকা লাগে।

20241030_170352.jpg

সবাই সবার কাছের মানুষদের ভাল রাখুন। কাছের মানুষগুলো প্রিয় মানুষগুলো অথবা যারা আপনাদের ভালোবাসে তারা একদিন না একদিন আপনাদের ছেড়ে চলে যাবে , তাই তাদের সাথে বেশি মান অভিমান করতে যাবেন না। কারণ এই জীবনে ভালবাসার মানুষ খুব কম পাওয়া যায়।।

সবশেষে একটা কথাই বলতে চাই,
কত প্রদীপ নিভে গেছে জীবন থেকে!
তবুও আলোর দিনে প্রদীপ বানাই সবাই।
আবার নতুন করে প্রদীপ জ্বালি কত!
সেটাও সময় মত হঠাৎ নিভে যায়।

এর নামই হয়তো জীবন।

Sort:  
Loading...
Loading...
 2 months ago 

সত্যি আমি মনে করি যারা তাদের জীবনে দাদু ঠাম্মার আদর ভালোবাসা পেয়েছে তাদের মতো সৌভাগ্যবান এই পৃথিবীতে আর কেউ নেয়। আমি অতটাও সৌভাগ্যবতী নই। আমি ছোট থেকে কখনো আমার ঠাম্মা কাউকেই দেখিনি।

আমার জন্মের অনেক আগেই আমার দাদু মারা যান। আর আমার জন্মের সময় আমার ঠাম্মা বেঁচে ছিলেন। তবে জ্ঞান হওয়ার আগেই তিনি মারা যান। তাই আমার মনে দাদু বা ঠাম্মা এদের কোন প্রতিচ্ছবি নেই। বাড়িতে কোন ফটো না থাকায় দাদু ঠাম্মা কেমন দেখতে ছিল সে বিষয়ে আমার কোন ধারণা নেই। তাই দাদার আদর ভালোবাসা ঠিক কেমন হয় আমার জানা নেই।

তবে তোর লেখাটা আমি অনেকটা রিলেট করতে পারলাম কারণ ২০১০ সালে আমি আমার বাবাকে হারাই। ২০১০ সালের আগে প্রত্যেক বছর কালী পূজার সময় বাবা ১৪ প্রদীপ বানাতো। আমি আর দাদা সামনে বসে বাবার প্রদীপ বানানো দেখতাম আর বাবাকে সাহায্য করতাম। কত সুন্দর ছিল সেই দিনগুলো।

আমিও চোখের সামনে প্রথম মৃত্যু বলতে বাবাকেই দেখেছিলাম তাই ঐটুকু বয়সে আঘাতটাও অনেকটাই পেয়েছিলাম।

যেহেতু পুজোর মধ্যেই বাবা মারা যান তাই পুজো এলেই বাবার কথা বড্ড মনে পড়ে।